আবার মাইকেল কর্লিয়নির সাথে দেখা করল নেরি। খোলাখুলি সে নিজের ইচ্ছের কথাটা বলল তাকে। ভেগাসে নয়, নিউ ইয়র্কে কর্লিয়নি পরিবারের কাজ করতে চায় সে। মাইকেলের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করল সে। বলল, উপকারীর ঋণ প্রাণ দিয়ে হলেও পরিশোধ করার চেষ্টা করবে সে। কথাটা বলে নিজের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত করতে চাইল মাইকেলকে। মাইকেল যে মুগ্ধ হয়েছে, তাও লক্ষ করল নেরি। সেদিনই সব কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। প্রথমেই শর্ত দিল মাইকেল, কর্লিয়নিদের খরচে মায়ামীতে গিয়ে লম্বা একটা ছুটি উপভোগ করে আসতে হবে নেরিকে। ওখানে কর্লিয়নিদের হোটেল আছে, সেখানে একবার গিয়ে উঠলেই হবে, নেরির আরাম-আয়েশের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেবে তারা। সেই সাথে পুরো এক মাসের বেতন অ্যাডভান্স দিয়ে দেয়া হলো ওকে।
জীবনে এই প্রথম বিলাসিতার স্বাদ পেল অ্যালবার্ট নেরি। হোটেল কর্তৃপক্ষ সাঙ্ঘাতিক খাতির করল তাকে। আদর-যত্নের কোন ত্রুটি হলো না। ম্যানেজার, বলল, আপনার অযত্ন হলে রক্ষা থাকবে কারও? আপনি যে কর্লিয়নিদের বন্ধু মানুষ! হোটেলের সবচেয়ে সৌখিন আর দামী সুইটটা দেয়া হয়েছে তাকে। ঠেকায় পড়ে বা দয়া করে যেমন গরীব আত্মীয় স্বজনকে সস্তা একটা ঘর দেয়া হয়, ব্যাপারটা সেরকম নয়। নাইট ক্লাবের ম্যানেজার নিজে এসে নিয়ে গেল একদিন নেরিকে, কয়েকটা অপূর্ব সুন্দরী মেয়ের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিল সে।
ছুটি কাটিয়ে আবার একদিন নিউ ইয়র্কে ফিরে এল নেরি। জীবন সম্পর্কে এই কদিনে ধারণাটা মোটামুটি বদলে গেছে তার। ক্লেমেঞ্জার দলে ভর্তি করে নেয়া হলো তাকে। কমী যাচাই করার ব্যাপারে ক্লেমেঞ্জার তুলনা মেলা ভার, এ কর সে যেমন দক্ষ, তেমনি মেজাজী। সম্ভাব্য সব উপায়ে নেরিকে পরীক্ষা করে নিল সে। হাজার হোক, পুলিশের লোক ছিল নেরি। তবে আসল কথা হলো, জন্ম সূত্রে পাওয়া একটা হিংস্রতা আছে ওর চরিত্রে। আইন মানে না এমন লোকদের হয়ে কাজ করার ব্যাপারে তার মনে একটু যদি দ্বিধা এসেও থাকে, ওর ভয়ঙ্কর হিংস্রতার জোয়ারে সব একেবারে বেমালুম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এক বছরও লাগল না, অপরাধ জগৎ সম্পর্কে একেবারে ঝানু হয়ে উঠল অ্যালবার্ট নেরি। ইতিমধ্যে পূর্ব জীবনে ফিরে যাবার পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
নেরির কথা উঠলেই প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে ক্লেমেঞ্জা। ওর তুলনা হয় না, ঠিক যেন লুকা ব্রাসির আধুনিক সংস্করণ। গর্ব করে ক্লেমেঞ্জা এতদূর পর্যন্ত বলে, লুকাকেও ছাড়িয়ে যাবে নেরি। নেরিকে ক্লেমেঞ্জাই আবিষ্কার করেছে, গর্ব তো একটু হবেই তার।
শারীরিক দিক থেকে নেরিকে শুধু বিদ্যুতের সাথেই তুলনা করা চলে। তার ক্ষিপ্র গতি, আর সমন্বয়বোধ লক্ষ করে নির্দিধায় বলে দেয়া যায়, ইচ্ছে করলেই আরেকজন বেসবল প্রতিভা জো ডিম্যাজিও হতে পারত সে। ক্লেমেঞ্জা এও জানে যে নেরির মত একটা প্রাকৃতিক শক্তিকে সামলানো তার কাজ নয়। তাই ঠিক হলো, সরাসরি মাইকেল কর্লিয়নির কাছে জবাবদিহি করবে ননরি, প্রয়োজনে টম হেগেনের মধ্যস্থতায়। নেরির সাথে আর কারও তুলনা হয় না, তাই আর সবার চেয়ে বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে বেশি পায় সে। কিন্তু স্বতন্ত্র একটা জীবিকার ব্যবস্থা তাকে করে দেয়া হয়নি। সৈনিক পোষা বা বুকমেকিং-এর একটা ব্যবসা, এসব নয়।
কিছুদিন যেতেই সবাই লক্ষ করে খুশি হলো যে একমাত্র মাইকেল কর্লিয়নিকে অগাধ ভক্তি করে নেরি। মাইকেলের ব্যাপারে একেবারে অন্ধ সে। ঠাট্টা করে একদিন হেগেন বলল মাইকেলকে, দুঃখ করার আর কোন কারণ নেই তোমার, মাইকেল। তোমার লুকা ৰাসিকে পেয়ে গেছ তুমি।
সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাল মাইকেল। সন্দেহ নেই, একটা কাজের মত কাজ করা গেছে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কর্লিয়নি পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে নেরি। তার বিশ্বাস যাতে অবিচল থাকে তার জন্যে কৌশল প্রয়োগ করছে ওরা। বলা বাহুল্য, কৌশলটা মাইকেল তার বাবার কাছ থেকেই শিখেছে। বাবার শিষ্যত্ব বরণ করার পর একদিন তাকে জিজ্ঞেস করল মাইকেল, আমি তো ভেবে পাই না লুকা ৰাসির মত একজন লোককে তুমি কিভাবে কাজে লাগালে। একটা জানোয়ার ছাড়া কি বলা যায় ওকে?
ছেলের প্রশ্ন শুনে হাসলেন ডন কর্লিয়নি। বললেন, আয়, বোস। ছেলেকে কিছু জ্ঞান দান করতে বসলেন তিনি। বললেন, দুনিয়ায় এমন কিছু মানুষ আছে যারা নিজেরাই খুন হতে চায়। এ-ধরনের লোক তোমার চোখেও পড়েছে। জুয়া খেলতে বসে খামোকা ঝগড়া বাধিয়ে বসে তারা, না জেনে কেউ যদি এদের গাড়িতে একটু আঁচড় কাটে, অমনি লাফ দিয়ে নিচে নেমে মারপিট শুরু করে দেয়। নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী লোকের সাথে লড়তে যায়, তাদের আসল ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু না জেনেই। লোকটা কে তা না জেনেই যাকে তাকে অপমান করে, তার ওপর অত্যাচার চালায়। একজন লোকের কথা মনে পড়ছে আমার, একদল ভয়ঙ্কর লোককে অকারণে অপমান করছিল সে, অথচ নিজের না ছিল শক্তি, না ছিল পৃষ্ঠপোষকতা। এরা হচ্ছে সেই জাতের লোক যারা দিন রাত চেঁচাচ্ছে-আমাকে খুন করো! আমাকে খুন করো! মজার ব্যাপার হলো, একদল লোক ঠিকই জুটে যায় যারা এদের অনুরোধ রক্ষা করতে সাঙ্ঘাতিক উৎসাহী। খবরের কাগজে এ ধরনের ঘটনার কথা আমরা রোজই পড়ছি। নিজেদের তো বটেই, এরা অন্য লোকেরও প্রচুর ক্ষতি করে বেড়ায়।