গল্পগুজব করে খানিকটা সময় কাটাল ওরা। খুব চাপা স্বভাবের লোক নেরি, ঘনিষ্ঠ লোকজনদের সাথেই বেশি কথা বলে না সে, কিন্তু সদ্য পরিচয় হলেও মাইকেলের সাথে মন খুলে কথা বলছে আজ। খুব বেশি হলে মাইকেলের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট হবে সে, কিন্তু এমন ভাবে কথা বলছে, মাইকেল যেন তার চেয়ে অনেক বড়, তার বাপের বয়েসী।
তারপর কাজের কথায় এল মাইকেল। প্রসঙ্গটা কৌশলে পড়ল ও, বলল, যাক, ভালয় ভালয় তোমাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা গেছে, সেটাই আসল কথা। তবে, তাতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে, তা ভেব না। একটা বিপদ থেকে কাউকে উদ্ধার করে তাকে আবার সাগরে ভাসিয়ে দেয়া আমার নীতি নয়। তুমি চাইলে তোমার জন্যে কিছু কাজের ব্যবস্থা করতে পারি আমি। লাস ভেগাসে আমাদের বৈষয়িক স্বার্থ আছে, তোমার যা অভিজ্ঞতা, তাতে অনায়াসে ওখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারো তুমি। অথবা তুমি হয়তো ছোটখাট একটা ব্যবসার মালিক হতে চাও। তাতেও খুশি হব আমি পুঁজি যদি না থাকে, ব্যাংক থেকে লোন পাবার ব্যবস্থাও করে দিতে পারব।
কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে পড়ল নেরি। নিজেকে তার তুচ্ছ আর মাইকেলকে মহান বলে মনে হচ্ছে। অদ্ভুত একটা কুণ্ঠাবোধ করলেও গর্বের সাথে মাইকেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল সে। তারপর বলল, শাস্তি থেকে রেহাই পেলে কি হবে, ওই আদালতের নাগালের বাইরে যেতে পারব না আমি।
ওসব কথার কথা, তাড়াতাড়ি বলল মাইকেল, আদালতের ওই নিষেধাজ্ঞা যাতে তুলে নেয়া হয় তার ব্যবস্থা আমি করতে পারব। আর ব্যাংক থেকে যাতে কোন আপত্তি না ওঠে তার ব্যবস্থাও করা সম্ভব, পুলিশের খাতা থেকে তোমার নামটা কেটে দেয়া এমন কোন কঠিন কাজ নয়।
এসব অত্যন্ত ঝামেলার কাজ, জানে নেরি। তার জন্যে মাইকেল এত ঝামেলা কাঁধে নিতে চাইছে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল সে। মৃদু গলায় বলল, ঠিক আছে। কখনও যদি সাহায্য দরকার হয়, আপনাকে জানাব।
খুব খুশি হলাম আমি, বলল মাইকেল। এখন চলো, আমার বাড়ির লোকেরা খাবার টেবিলে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। বাবা তোমার সাথে পরিচিত হতে চেয়েছেন। এইটুকু পথ, চলো তার বাড়িতে আমরা হেঁটেই যাই। তোমাকে নিয়ে যেতে দেরি করলে মা আবার রাগ করবে আমার ওপর। হাল মাইকেল। লংকা ভাজা, ডিম, সসেজ, আরও অনেক কিছু–একেবারে খাঁটি সিসিলীয় নিয়মে তৈরি করা।
সেই কৈশোরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে অ্যালবার্ট নেরির। তারপর থেকে আর কোন দুপুরবেলা এত আনন্দে কাটেনি তার। সেই পনেরো বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে, সেই থেকে আনন্দের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে সে। কিন্তু আজ সদ্য পরিচিত একটা পরিবারের সদস্যদের সাথে খেতে বসে এমন আপনজনের মত। ব্যবহার পাচ্ছে, রীতিমত অভিভূত হয়ে পড়ছে মনটা। আশ্চর্য প্রসন্ন মেজাজে তাকে অভ্যর্থনা করলেন ডন কর্লিয়নি। নেরিকে কথা বলিয়ে তিনিই আবিষ্কার করলেন, নেরির বাবা-মার আদি বাসস্থান থেকে তাদের গ্রামে যেতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। নেরি কর্লিয়নিদের এক রকম ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। খুব উৎসাহী হয়ে উঠলেন ডন। গল্পগুজব করার জন্যে অনেকটা সময় দিলেন তিনি নেরিকে। ভোজের ব্যাপক আয়োজন রয়েছে, খাবারগুলো আশ্চর্য উপাদেয়, গাঢ় লাল রঙের মদ, বড়ই পুষ্টিকর। কর্লিয়নিদেরকে একান্ত আপনওন বলে মনে হলো নেরির। লক্ষ করল, এদের কোন গর্ব নেই, এরা দাম্ভিক নয়, উপকারের বিনিময়ে কিছু চায় না। উলে তার জন্যে আরও কিছু করতে পারে কিনা জানতে চাইছে বারবার। পরিষ্কার বুঝতে পারছে সে, আজ সে এই পরিবারে বহিরাগত মেহমান হলেও সে যদি চায়, এই পরিবারে একটা স্থায়ী আসন পেয়ে সুখী হতে পারে।
বিদায় দেবার সময় মাইকেল এবং ডন স্বয়ং যে সৌজন্য দেখালেন, জীবনে কখনও তা ভুলবে না নেরি। ওর গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে এলেন তারা। সহাস্যে ওর হাত ধরে নেড়ে দিলেন ডন। বললেন, তুমি খুব ভাল ছেলে, নেরি। তোমার সাথে আলাপ করে খুব খুশি হয়েছি আমি। এই যে আমার ছেলে মাইকেলকে দেখছ, জলপাই তেলের ব্যবসা শেখাচ্ছি ওকে আমি। বয়স বাড়ছে তো, এবার অবসর নিতে হবে। কিছুদিন আগে হঠাৎ আমার কাছে এসে তোমার নাম করল, বলল এই ছেলেটা খুব ভাল, দুর্ভাগ্যক্রমে সাঙ্ঘাতিক একটা বিপদে পড়ে গেছে, সেই বিপদ থেকে একে উদ্ধার করতে হবে-বাবা, তুমি চেষ্টা করলে ছেলেটা বেঁচে যায়। আমাকে একটু স্বস্তি পেতে দেয় না, সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। অবশেষে বাধ্য হয়ে তোমার ব্যাপারে নাক গলাতে হলো আমাকে। তোমাকে এত কথা বলার কারণ, এখন বুঝতে পারছি তোমার ব্যাপারে আমার সাহায্য চেয়ে খুব ভাল করেছিল ও। তোমার মত ভাল ছেলে হয় না। কখনও যদি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি, মুখ ফুটে চেয়ে উপকারটা। আমার কথা বুঝতে পারছ তো? তোমার জন্যে কিছু করতে পারলে আমরা খুশি হব।
মনস্থির করতে তিনদিনও সময় নিল না নেরি। ওকে তোয়াজ করা হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার। কিন্তু সেই সাথে এও বুঝল, যে কাজের জন্যে প্রচলিত সমাজ তাকে দোষী মনে করে শান্তি দিয়েছিল, সেই কাজকে অনুমোদন করে কর্লিয়নি পরিবার। কর্লিয়নি পরিবার ওকে গুরুত্ব দেয়, ওর মূল্য বোঝে, কিন্তু সমাজ ওকে পাত্তাই দেয় না, মূল্য বোঝা তো পরের কথা। কর্নিয়নি পরিবার ওর প্রশংসা করে, সমাজ ওর নিন্দা করে। কর্লিয়নিরা নিজেদের চেষ্টায় আলাদা একটা জগৎ সৃষ্টি করেছে, সেখানে তার মত লোক সুখে থাকতে পারে আরও একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পারল নেরি, বৃহং সমাজের চেয়ে কর্লিয়নিদের সমাজ অনেক বেশি শক্তিশালী। এদের সমাজে থাকতে পারলে তার হাতেও অনেক ক্ষমতা আসবে। টাকা, আরাম-আয়েশ, সম্মান, দাপট এসব তো আসবেই।