এলিভেটর থেকে নামলেন ডন কর্লিয়নি। তাকে দেখেই ডানা ঝাপটে সবাই ছুটে এল পরম আশ্রয়ের জন্যে। দশাসই চেহারা মায়ের, মেয়েগুলো সাধারণ, মোটাসোটা। ডনের গলা ছুঁয়ে বিলাপ জুড়ে দিল গেনকোর স্ত্রী, দেবতার চেয়ে কম কিসে তুমি, ছুটে এসেছ নিজের মেয়ের বিয়ে ফেলে।
এসব প্রশংসা গায়ে না মেখে ডন কর্লিয়নি বললেন, গেনকো আমার শরীরের একটা অংশের মত, আজ বিশ বছর ধরে। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আমি আসব না তো কে আসবে?গেনকোর স্ত্রীর কল্পনাতেও নেই যে আজ রাতে তার স্বামী মারা যাবে, একথা বুঝতে দেরি হয়নি ডন কর্লিয়নির।
ক্যান্সারের শিকার গেনকো আবানদাণ্ডো আজ প্রায় এক বছর ধরে এই হাসপাতালে শুয়ে আছে। সে যে দ্রুত মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে একথা ভাল করে বোঝেনি তার স্ত্রী। স্বামীর অসুখটাকে স্বাভাবিক জীবন যাত্রার একটা অংশ বলে ধরে নিয়েছে সে। ভেবেছে, আরেকটা সঙ্কটকাল হাজির হয়েছে আজ রাতে, তার বেশি কিছু না। একনাগাড়ে কথা বলে চলেছে সে, ভিতরে গিয়ে দেখে এসো ওকে। ডাকছিল তোমাকে। জানো, খুব ইচ্ছে ছিল বেচারির তোমার মেয়ের বিয়েতে গিয়ে আশীর্বাদ করার, কিন্তু ডাক্তার একেবারেই ছাড়তে চাইল না। ও-ই আবার বলল, দেখো, উনি আজকের দিনে আমাকে দেখতে আসবেন। সত্যি বলছি, আমি তো ভাবতেই পারিনি। বন্ধুত্বের মেয়েরা কি বোঝে, বলো? সুতরাং আমার দোষ দিতে পারো না। বন্ধুত্বের মূল্য তোমরা, পুরুষরা দিতে জানো। যাও, খুব খুশি হবে তোমাকে দেখে।
নার্স আর ডাক্তার বেরিয়ে এল বারান্দায়। ডাক্তারটি অল্প বয়েসী, গভীর। হাব, ভাব দেখে মনে হয় হুকুম চালাবার জন্যেই দয়া করে এই দুনিয়ার মাটিতে পা রেখেছে, চাল-চলনে বড়লোকি ভাবটা প্রকট। গেনকোর মেয়েদের একজন খুব সাবধানে দয়া ভিক্ষার সুরে জানতে চাইল, এখন বাবাকে দেখতে যাব, ডা. কেনেডি?
রাজ্যের বিরক্তি ফুটে উঠল ডা. কেনেডির চেহারায়। কেবিনের রুগী মরতে যাচ্ছে তা কি এরা সত্যি বুঝতে পারছে না? লোকটাকে শান্তিতে মরতে দিলেই কি ভাল করত না? ওর বাড়ির লোকজন ছাড়া একজনও কেবিনে ঢুকবেন না, বলল সে।
কিন্তু পরমুহূর্তে সে দেখল ভারিক্কী চেহারার খাটো এক লোকের দিকে সবাই ফিরে দাঁড়াল, যেন তাঁর ইচ্ছাতেই সব হবে। লোকটাকে তেমন কিছু মনে হলো না ডাক্তার কেনেডির! একেবারে আনাড়ি লোক, কিভাবে সান্ধ্য পোশাক পরতে হয় তাই জানা নেই। তার দিকে তাকিয়ে লোকটা একটা প্রশ্ন করল, উনি কি আজই মারা যাবেন, ডাক্তার সাহেব? কণ্ঠস্বরে ক্ষীণ ইতালীয় টান।
হ্যাঁ, গভীরভাবে জবাব দিল ডাক্তার।
আপনারা তাহলে কাঁধ থেকে দায়িত্ব নামান, বললেন ডন কর্লিয়নি। এখন থেকে আমরা ভার নেব। ওঁকে সান্তনা দেয়া, ওঁর চোখ বন্ধ করা-সব আমরা, করব। ওঁকে মাটিতে শোয়ার সময় আমরাই ফেলব চোখের পানি। তারপর, ওর স্ত্রী-কন্যাদের ভরণ পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সেটাও নেব আমরা।
ডন কর্লিয়নিকে এমন স্পষ্টভাবে কথা বলতে শুনে সব বুঝে ফেলল গেনকোর স্ত্রী। কাঁদতে শুরু করল সে।
কাঁধ ঝাঁকাল ডাক্তার কেনেডি। গেঁয়ো ভুতদের সাথে কথা বলতে যাওয়াই ঝকমারি! তবে লোকটার কথার মধ্যে যে যুক্তি আছে তাও স্বীকার করতে হলো তাকে। সাদা কোট উড়িয়ে লম্বা বারান্দা ধরে হন হন করে চলে গেল সে।
আবার কেবিনে ফিরে গেল নার্স। একটু পর আবার বেরিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, উনি প্রলাপ বকছেন। খুব জ্বর, খুব ব্যথা। বেশি কথা বলবেন না। ওঁর স্ত্রী ছাড়া আর কারও দুএক মিনিটের বেশি ওখানে থাকা চলবে না। চলে যাবার আগের মুহূর্তে নার্স হঠাৎ জনি ফন্টেনকে দেখে চিনতে পারল। বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে চোখ দুটো বিস্ফারিত হলো তার। জনি ফন্টেন তাকে স্বীকৃতি দিয়ে হাসছে দেখে পুলকিত হয়ে উঠল মেয়েটা। যখন খুশি এলেই আমাকে পেতে পারো, চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে এই দাওয়াত দিয়ে রাখতে ভুল করল না সে।
ভবিষ্যতে প্রয়োজন লাগতে পারে ভেবে মেয়েটার কথা মনে গেঁথে রাখল জনি, তারপর সবার শেষে কেবিনে ঢুকল।
দৌড় প্রতিযোগিতায় মৃত্যুর সাথে হেরে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে খাটে শুয়ে আছে গেনকো আবানদাণ্ডো। মাংসহীন কঙ্কাল একটা। মাথা ভর্তি কালো চুলের নাম নিশানাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, পাকানো নোংরা দড়ির মত হয়ে গেছে সেগুলো।
গলার স্বরে খুশির ভাব এনে ডন কর্লিয়নি বললেন, এই দেখো, গেনকো ভাই, আমার সাথে কারা এসেছে। ওরা তোমাকে ওদের শ্রদ্ধা জানাতে চায়। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আর একজন কে এসেছে দেখো। জনিরও ইচ্ছা তোমাকে সে তার শুভেচ্ছা আর শ্রদ্ধা জানাবে।
মুমূর্ষ গেনকো চোখ মেলে সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল ডন কর্লিয়নির দিকে। ছেলেরা সবাই তার পাটখড়ির মত সরু হাতটাকে ধরল। খাটের পাশে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওর স্ত্রী আর মেয়েরা। তারা সবাই গেনকোর গালে চুমো খেলো। তারপর তার অপর হাতটা ধরুল।
বিশ্বস্ত পুরানো বন্ধুর হাত ডন কর্লিয়নিও ধরলেন। খুব আন্তরিকতার সাথে তিনি বললেন, এবার তুমি সেরে উঠলেই, বুঝলে ভায়া, আর কেউ না, শুধু তুমি-আমি গিয়ে ইতালির আমাদের সেই গ্রামে একবার বেড়িয়ে আসব। বক্কিখেলার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার? মদের দোকানের সামনে বাবারা সেই যে খেলতেন? ঠিক করেছি, ছেলেমানুষের মত স্ফূর্তি অনুভব করছেন ডন কর্লিয়নি। গ্রামে গিয়ে ওই মদের দোকানের সামনে আমরা দুজন আবার,বক্কি খেলব।