সাত আট বছর আগের কথা। জনি ফন্টেন গায়ক হিসেবে নাম করে জনপ্রিয় ড্যান্স ব্যাণ্ডের সাথে গান গায়। কিছু দিনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হয়ে ওঠে সে রেডিওর। কিন্তু ব্যাপার্টির কর্তা লেস হ্যাঁলি পাঁচ বছরের একটা চুক্তি সই করিয়ে নিয়েছিল জনিকে দিয়ে। এই চুক্তি অনুযায়ী এখানে, সেখানে জনিকে গাধার খাটুনি খাঁটিয়ে মুনাফার বিস্তর টাকা নিজের পকেটে ভরার অধিকার ছিল লেস হ্যাঁলির। এই নিয়েই লাগল গণ্ডগোল। একটা আপোস রফার চেষ্টা করলেন ডন কর্লিয়নি। চুক্তিটা যদি লেস হ্যাঁলি বাতিল করে, তাকে তিনি এককালীন বিশ হাজার ডলার দেবেন। কিন্তু রাজি হলো না, লেস হ্যাঁলি। সে দাবি করছিল জনির মোট আয়ের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। হেসেছিলেন ডন। প্রস্তাবটা বদলালেন। নতুন প্রস্তাবে বললেন, বিশ নয়, দশ হাজার ডলার দেবেন তিনি লেস হ্যাঁলিকে। সে লোকটা দুনিয়ার কোন খবর রাখত না। সুতরাং টাকার অঙ্ক কমে যাবার কি অর্থ তা তার মাথায় ঢুকলই না। বলাই বাহুল্য, এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল সে।
ডন কর্লিয়নি নিজে দেখা করলেন লোকটার সাথে। সাথে গেল তার সবচাইতে অন্তরঙ্গ দুজন বন্ধু। একজন তার মন্ত্রণাদাতা, গেনকো আবানদাণ্ডো, অপরজন লুকা ব্রাসি। সেখানে আর কেউ ছিল না। ডন কর্লিয়নি একটা দলিলে সই নিলেন লেস হ্যাঁলির। দশ হাজার ডলার পেল সে, আগের চুক্তিটা বাতিল হয়ে গেল।
কিভাবে! এই তো বললে লেস হ্যাঁলি রাজি হয়নি?
বাবা তার কপালে পিস্তল ধরে বলেছিলেন, এক মিনিটের মধ্যে হয় সই করো, না হয় দলিলে তোমার মাথার ঘিলু পড়বে!
ঘাবড়ে গেছে কে। ভুরু কুঁচকে চিন্তিতভাবে বলল, তোমার বাবা দেখছি আধুনিক রবিন হুড। ভোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে অন্যের জন্যে কিছু না কিছু সবসময় তিনি করছেন। ঠোঁট বাঁকা করে ব্যঙ্গের হাসি হাসল সে। ওঁর পদ্ধতিগুলো আইনসম্মত নয়, এই যা।
যাই শোনাক না কেন, একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল মাইকেল, আসল ব্যাপারটা হলো: মেরু অভিযাত্রীদের কথা তো শুনেছ তুমি? যারা যাবার পথে এখানে ওখানে লুকিয়ে রেখে যায় খাবার, বিপদের পুঁজি, ফেরার পথে যদি দরকার হয়, মনে করে? বাবার উপকার আর অনুগ্রহগুলো ঠিক সেই খাবারের পুঁজির মত, প্রয়োজনের সময় সবার বাড়িতে গিয়ে ফেরত চাইবেন, তখন না দিলেই বিপদ।
মেহমানদের বিদায় নিতে নিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাস্তায় এখন একটাই মাত্র গাড়ি দেখা যাচ্ছে। কালো লম্বা ক্যাডিলাক। ড্রাইভিং সীটে বসে আছে ফ্রিডো। তার পাশে বসলেন ডন কর্লিয়নি। পিছনের সীটে সনি, মাইকেল আর জনি ফন্টেন।
তোমার বান্ধবীর কথা বলছি, ডন কর্লিয়নি তার কনিষ্ঠ পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, একা শহরে ফিরতে পারবে সে?
টম ব্যবস্থা করবে বলেছে।
মনে মনে মন্ত্রণাদাতার যোগ্যতায় খুশি হলেন ডন। সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা নাড়লেন তিনি।
পেট্রলের রেশন থাকায় ম্যানহাটনের দিকে যাবার সময় বেল্ট পার্কওয়েতে যানবাহন একেবারে নেই বললেই চলে। ফ্রেঞ্চ হাসপাতালে পৌঁছতে পুরো এক ঘন্টাও লাগল না। পথে দুএকটা কথা হলো। ডন কর্লিয়নি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকেই দ্বিতীয় প্রশ্নটি করলেন, পড়াশোনা ঠিকমত চলছে তো?
মাথা ঝাঁকাল শুধু মাইকেল।
সনি বলল, জনির ব্যাপারটা তুমি মিটিয়ে দিচ্ছ শুনলাম? চাও আমি গিয়ে সাহায্য করি?
সামান্য ব্যাপার, সংক্ষেপে বললেন ডন।
ঠিক উল্টো ধারণা জনির, হাসল সনি। সেজন্যেই মনে করলাম তুমি হয়তো আমাকে পাঠাবে।
মাথা ঘুরিয়ে পিছনে বসা জনির দিকে তাকালেন ডন। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না কেন তুমি? করব বলেছি অথচ করিনি এমন কোন উদাহরণ দেখাতে পারো? শুনেছ কোনদিনকেই আমাকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে?
কেঁচো হয়ে গেল জনি ফন্টেন। ভয়ে ভয়ে বলল, গড ফাদার, ও ব্যাটা একটা ৯০ ক্যালিবারের শয়তান। কিছুতেই ওর কথার নড়চড় হয় না। সবচেয়ে ভয় পাচ্ছি; লোকটা ঘৃণা করে আমাকে। আমার মাথায় ঢুকছে না কি করে আপনি এর ফয়সালা করবেন…
সস্নেহে কৌতুক করলেন ডন। বললেন, কথা যখন দিয়েছি, ফয়সালা তো যেভাবে হোক করে দিতেই হবে। দেখি! কনিষ্ঠ পুত্র মাইকেলের পাজরে খোঁচা মারলেন তিনি। আর যাই হোক, তুমি আমার ধর্মপুত্র, তোমাকে তো আ, দুর্দশায় ফেলতে পারি না, কি বলো, মাইকেল?
জীবনে কখনও এক সেকেণ্ডের জন্যেও বাবাকে অবিশ্বাস করেনি মাইকেল। সায় দেবার ভঙ্গিতে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল সে।
হাসপাতালের ফটক দিয়ে ঢোকার সময় মাইকেলের কনুইয়ের উপরটা ধরলেন ডন কর্লিয়নি। কাজেই ওদেরকে ওখানে রেখে এগিয়ে গেল বাকি সবাই। লেখাপড়ার পাট চুকলে, ছোট ছেলেকে বললেন তিনি, আমার কাছে এসো একবার কথা আছে। তোমার ভাল লাগবে এমন কিছু পরিকল্পনা করেছি আমি।
মাইকেল চুপ করে থাকল। তাই দেখে বেজার হয়ে ভারি গলায় ডন বললেন, তোমাকে আমি চিনি। এমন কিছু করতে বলব না যা তোমার পছন্দ হবে না। জেনে রেখো, সাধারণ কোন ব্যাপার নয়-বড় তত হয়েছ, যা ভাল বোঝো করো। কিন্তু বইগুলো গেলা শেষ করে, আর সব ছেলে যেমন করে, আমার কাছে তুমিও একবার এসো।
চওড়া বারান্দার সাদা টালি বসানো মেঝেতে এক ঝাক মোটাতাজা কালো কাক বসে আছে, যেন। ওরা সবাই গেনকো আবানদাণ্ডের পরিবারের লোকজন। গেনকোর তিন মেয়ে আর তার স্ত্রী, শোকের প্রতীক কালো পোশাক পরে এসেছে সবাই।