হাত বাড়িয়ে কনেকেও মঞ্চে তুলে নিল জনি। জনি আর নিনোর মাঝখানে দাঁড়াল কনি। ম্যাণ্ডোলিনের তার থেকে কয়েকটা কর্কশ পদ বের করল নিনো। এটা পুরানো একটা রুটিন ওদের-নকল যুদ্ধ, এবং প্রেম বিনিময়। তরোয়ালের মত তীক্ষ্ণ ধার কণ্ঠস্বরে, একেকজন পালা করে গান ধরছে। সূক্ষ্ম সৌজন্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিনোর কণ্ঠকে নিজের গলার উপরে ছাপিয়ে উঠতে দিল জনি, কনেকে হরণ করে নিতে দিল ওর হাত থেকে বিজয়ীর শেষ চরণটি গাইতে দিল নিনোকেই, আস্তে আস্তে বহুদূরে মিলিয়ে গেল জনির গলা। গান শেষে বিয়ে বাড়িতে উদ্দাম আনন্দের ঢেউ আর উচ্ছ্বসিত জয়ধ্বনি শুরু হলো। শেষদিকে ওরা তিনজন আলিঙ্গন করছে পরস্পরকে। ওদিকে আরেকটা গানের দাবিতে মেহমানদের চিৎকার শুরু হয়েছে।
শুধু ডন কর্লিয়নি, কোণার ঘরটার দরজার কাছে একা দাঁড়িয়ে সন্দেহ করছিলেন, কোথায় যেন গোলমাল আছে একটা। প্রফুল্ল মুখে অমায়িক হেসে, মেহমানদের কারও মনে দুঃখ না দিয়ে, সবাইকে ডেকে তিনি বললেন, আমার ধর্ম পুত্র, আমাদেরকে সম্মান দেখানোর জন্যে এতদূর থেকে এসেছে, গলা ভেজাবার জন্যে ওকে কিছু দেবার কথা কারও মনে পড়ল না? কথাটা শেষ হতে যা দেরি, সাথে সাথে দশ বারোটা মদ ভর্তি গ্লাস জনির দিকে এগিয়ে দেয়া হলো। সব গ্লাসে একটা করে চুমুক দিল জনি, তারপর ছুটল ধর্ম-বাপকে আলিঙ্গন করতে।
ধর্ম-বাপকে বুকে চেপে ধরে এক কে তার কানে কানে কিছু বলল জনি। তিনি আর তাকে হাতছাড়া করলেন না, সাথে করে বাড়ির ভিতর নিয়ে চলে গেলেন।
জনি ফন্টেনকে ঘরে ঢুকতে দেখেই করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল টম হেগেন। কেমন আছ? করমর্দন করল বটে জনি, কিন্তু সবাই জনির যে উষ্ণ, গভীর অন্তরঙ্গতার প্রশংসা করে তার কোন প্রকাশ ঘটল না। ডন কর্লিয়নির যাবতীয় অপ্রিয় কাজ যাকে করতে হয়, এইটুকু শাস্তি তাকে তো নিতেই হবে মাথা পেতে।
নিমন্ত্রণ পেয়েই ভাবলাম, যাক, ধর্ম-বাপের রাগ হলে পানি হয়ে গেছে, ডনকে বলছে জনি। বউকে ডিভোর্স করার পর ফোন করেছিলাম আপনাকে পাঁচবার, টমের গলায় শুনেছি হয় আপনি বেরিয়ে গেছেন, নয় এই মুহূর্তে সাংঘাতিক ব্যস্ত। বুঝতে অসুবিধে হয়নি রেগে কাঁই হয়ে আছেন আমার ওপর।
হলুদ বোতল থেকে মদ ঢেলে গ্লাস ভরে দিলেন ডন। আচ্ছা, থাক, হয়েছে। এখন ওসব মনে নেই। এখনও কিছু করতে পারি নাকি তোমার জন্যে? এত বড়লোক হয়ে যাওনি, এত নাম কিনে ফেলোনি তো যে তোমার জন্যে আমার আর কিছুই করার নেই?
তরল অনলের মত মদটুকু গিলে নিয়ে আবার গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল জনি। গলার স্বরে বানোয়াট একটা স্ফূর্তির ভাব আনতে চেষ্টা করে বলল, এখন তো আর আমি বড়লোক নই, গড ফাদার! পতন শুরু হয়ে গেছে আমার। আপনার কথাই ফললো। কি কুক্ষণে চরিত্রহীনা মেয়েটাকে বিয়ে করলাম, তার জন্যে, স্ত্রী আর মেয়েদেরকে পর করে দিয়ে ভাল করিনি আমি। এখন বুঝি, আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আপনি অন্যায় কিছু করেননি।
শ্রাগ করলেন ডন। আর যাই হোক, তুমি আমার ধর্ম-পুত্র তো, তোমার জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল-এই আর কি।
অস্থির হয়ে উঠে ঘরের মেঝেতে পায়চারি শুরু করে দিল জনি। পাজী, শয়তান মেয়েমানুষটার জন্যে বদ্ধ পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। হলিউডের আকাশে সবচেয়ে দামী তারকা, পরীর মত দেখতে। জানেন, শুটিং শেষ হলে কি করে? মেকআপম্যানের কাজ যদি মনের মত হয়, দেহ দেয় তাকে। ক্যামেরাম্যান যদি যত্ন করে ছবি তোলে, নিজের ড্রেসিংরুমে ডেকে এনে তাকে দিয়ে কাপড় খোলায়। কাউকে খুশি করার জন্যে আমি যেমন পকেট থেকে খুচরো পয়সা দিই বকশিশ হিসেবে, তেমনি ও দেয় নিজের শরীরটাকে। বেশ্যা।
ছোট্ট করে জানতে চাইলেন ডন, তোমার স্ত্রী আর মেয়েরা কেমন আছে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জনি। আদালত যা দিতে বলেছে তার চেয়ে বেশিই দিচ্ছি। প্রত্যেক হপ্তায় দেখা করতে যাই। ওদের কথা মনে পড়লে শান্তি পাই না। মাঝে মাঝে ভাবি, বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। আবার একবার গ্লাসে মদ ভরে নিল সে। আমার দ্বিতীয়পক্ষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে আজকাল। আমি নাকি সেকেলে, আমি নাকি আনাড়ি, আমার গান নিয়ে ব্যঙ্গ করে। কষে মারধোর করে এসেছি। ছবি করছে, তাই মুখে মারলাম না। সিগারেট ধরাল সে। এত কথা বলে আপনাকে আসলে বোঝাতে চাইছি, ধর্ম-বাপ, বেঁচে থাকার যে সুখ তা এখন আর আমার নেই। আমি অসুখী।
ডনের কণ্ঠে সরলতা প্রকাশ পেল, এসব ব্যাপারে তোমাকে যে সাহায্য করব তার কোন উপায়ই নেই। থামলেন তিনি, তারপর জানতে চাইলেন, গলায় কি হয়েছে?
সবটুকু আত্মবিশ্বাস, মাধুর্য নিমেষে চেহারা থেকে উবে গেল জনির। কণ্ঠস্বরে একটা হাহাকার ফুটে উঠল তার, গড ফাদার, গড ফাদার, আমার গলায় কিছু হয়েছে, ডাক্তাররা ধরতে পারছে না! গড ফাদার, আমি আর গাইতে পারি না।
জনিকে এভাবে হঠাৎ ভেঙে পড়তে দেখে ডনের সাথে সাথে হেগেনও চমকে উঠল।
দুটো ছবি করে অনেক টাকা কামিয়েছিলাম, বলে চলেছে জনি। বিরাট স্টার বনে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন ওরা আমাকে তাড়াতে চাইছে। স্টুডিওর মালিক ব্যাটা প্রথম থেকেই আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না, সুযোগ বুঝে বদলা নিচ্ছে।
ধর্ম-পুত্রের সামনে দাঁড়ালেন ডন কর্লিয়নি। তার ভারি কণ্ঠস্বর গম গম করে উঠল, কেন সে তোমাকে দুচোখে দেখতে পারে না?