গলায় জোর এনে, স্পষ্ট স্বরে বনাসেরা বলল, যত টাকা লাগে দেব।
কথাটা শুনেই হেগেনের শরীর শক্ত কাঠ হয়ে গেল। কপালের কাছে দপ দপ করছে একটা শিরা। বুকের উপর দুটো হাত ভাঁজ করে রেখে দাঁড়িয়ে আছে সাল, মুখে মৃদু ব্যঙ্গের হাসি। ঘরের ভিতর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে, পাত্তাই দেয়নি সে এতোক্ষণ। এখন মনোযোগ না দিয়ে পারছে না।
চেয়ার ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন ডন কর্লিয়নি। মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। তুমি আর আমি, পরস্পরকে অনেক দিন থেকে চিনি আমরা। কিন্তু এতদিন হয়ে গেল, পরামর্শ বা সাহায্যের জন্যে কখনও তুমি আমার কাছে আসার প্রয়োজন বোধ করোনি। কই, মনে তো পড়ছে না শেষ কবে তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে কফি খেতে ডেকেছ। অথচ, আমার স্ত্রী তোমার মেয়ের ধর্ম-মা। শোনো, স্পষ্ট করেই বলি। পাছে আমার কাছে ঋণী হও, এই তোমার ভয়। তাই আমার বাড়িয়ে দেয়া বন্ধুত্বের হাত ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছ তুমি।
অস্পষ্ট গলায় বলল বনাসেরা, কোন গোলমালে নিজেকে জড়াতে চাইনি আমি…
কথা বলতে নিষেধ করার ভঙ্গিতে একটা হাত তুললেন ডন। চুপ! তুমি মনে করেছ আমেরিকা একটা স্বর্গ। চুটিয়ে ব্যবসা করছ, দুহাতে লুটছ টাকা, ভাবছ দুনিয়াটা কি মজার, কি নিরাপদ জায়গা–এখানে যা মন চায় তাই করা যায়। খাঁটি একজন বন্ধুর সাহায্য দরকার আছে বলে মনে করোনি, তাকে দিয়ে নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করোনি। ভেবেছ, এসব গোলমেলে ব্যাপার, নিজেকে খামোকা জড়িয়ে ফায়দা নেই। ভেবেছ, তোমাকে পাহারা দেবার জন্যে পুলিশ আছে, ন্যায় বিচারের জন্যে আদালত আছে। ভেবেছ, ডন কর্লিয়নির সাহায্য তোমার দরকার নেই। বেশ। মনে দুঃখ পেয়েছিলাম আমি, কিন্তু আমার বন্ধুত্বের মূল্যই যে দেয়, যে আমাকে অতি সামান্য বলে মনে করে, জোর জবরদস্তি করে তার ঘাড়ে আমার বন্ধুত্ব চাপাব আমি কি সেই বান্দা? কক্ষনো নই!
ভদ্রভাবে কাষ্ঠ হাসলেন, তারপর বললেন, অথচ লেজে পা পড়ায় এখন আবার আমার কাছে ছুটে এসেছ, বলছ, ডন, কর্লিয়নি, আমি সুবিচার চাই। তাও পরিবেশের পবিত্রতার মুখ চেয়ে কিছু শ্রদ্ধার সাথে বলছ না। এটা আমার বাড়ি, আজ আমার মেয়ের বিয়ে আর তুমি আমার কাছে এসে আমাকে বলছ খুন করতে, বনাসেরার কণ্ঠস্বর নকল করে ঘৃণার সাথে ডন কর্লিয়নি বললেন, বলছ, যত টাকা চান দেব, না-না, আমি রাগ করিনি। কিন্তু বলো তো, কি অপরাধ করেছি তোমার কাছে আমি, যার প্রতিশোধ নিচ্ছ, এত অসম্মান করছ আমাকে?
আতঙ্কের একটা যন্ত্রণা আছে, বনাসেরা সেই যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাচ্ছে। দিশেহারার মত বলতে লাগল, আমেরিকা আমার কত উপকার করেছে। ভাল নাগরিক হতে চেয়েছিলাম আমি। চেয়েছিলাম আমার মেয়ে হবে আমেরিকান মেয়ে…
হাত তালি দিয়ে দৃঢ় সমর্থন জানালেন ডন কর্লিয়নি। চমৎকার, খাসা বলেছ। তাহলে তো আর নালিশ করার কিছু থাকলই না। রায় দিয়েছেন জজ সাহেব। রায়। দিয়েছেন আমেরিকা সাহেব। ফুল আর এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে যেয়ো হাসপাতালে, তাতেই তোমার মেয়ে সান্তনা পাবে। তেমন কোন গুরুতরব্যাপার তো আর নয়, ওদের বয়স কম, উত্তেজনার পরিমাণ একটু বেশি, আবার শুনছি একজন নাকি প্রভাবশালী রাজনীতিকের ছেলে। না, ভাই আমেরিগো, তুমি অসৎ এ অপবাদ কখনও আমি দিতে পারব না। সতোর প্রতি তোমার শ্রদ্ধা, হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে। আমার বন্ধুত্ব উপেক্ষা করেছ, সেটা তেমন কিছু নয়, তবু অন্য কোন মানুষের চাইতে তোমার কথায় আমার আস্থা আছে। তাই কথা দাও, এসব পাগলামি ছাড়বে তুমি। আবেগের বশে যা চাইছ, কাজটা ঠিক আমেরিকান নয়। ওদেরকে মাফ করে দাও। ভুলে যাও। মেনে নাও, এমন কি আমেরিকাতেও দুর্ঘটনা ঘটে।
নির্মম অবহেলা, ব্যঙ্গ আর তাচ্ছিল্যের সাথে কথাগুলো বলে গেলেন ডন কর্লিয়নি। বনাসেরা কাঁপছে। তবু সাহস সঞ্চয় করে পুনরাবৃত্তি করল সে, সুবিচার আমি আপনার কাছে চাই।
সুবিচার আদালত দেয়নি তোমাকে?
একগুয়ে ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল নাসেরা। না। সুবিচার ওরা পেয়েছে। আমি পাইনি।
উপর নিচে মাথা নেড়ে এই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ অনুমোদন করলেন ডন কর্লিয়নি। কি চাও তুমি?
চোখের বদলে চোখ, অস্ফুটে বলল বনাসেরা। চোখ দুটো জ্বলে উঠল তার।
আরও বেশি চাইছিলে, ডন বললেন। তোমার মেয়ে তো মরেনি।
নিরাশ হলো বনাসেরা। দাবির পরিমাণ কমিয়ে বলল, তাহলে ওরাও যেন ওর মত কষ্ট পায়। বানাসেরা আরও কিছু বলবে, এই আশায় অপেক্ষা করে আছেন ডন কর্লিয়নি। সবটুকু সাহস দিয়ে বুক বেঁধে বসে বলল, কত টাকা দেব আপনাকে? হতাশ আর্তনাদের মত শোনাল কথাটা।
ঘুরে দাঁড়ালেন ডন কর্লিয়নি। এর অর্থ দূর হও তুমি! কিন্তু বাসেরা নড়ল না।
মনটা বড় তাল ডন কলিয়নির, দিকভ্রষ্ট বন্ধর উপর কতক্ষণই বা তিনি রাগ করে থাকতে পারেন? অবশেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, তারপর আবার ফিরলেন। ইতিমধ্যে বেঁচে থেকেও মরার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বনাসেরার চেহারা।
ধৈর্যের সাথে, কোমল গলায় বললেন ডন কর্লিয়নি, প্রথম থেকেই লক্ষ করেছি, আমাকে বিশ্বাস করতে ভয় পাও তুমি। আইনের কাছে সুবিচারের আশায় মাসের পর মাস অপেক্ষা করো তুমি। উকিলের পিছনে বস্তা বস্তা টাকা ঢালো। অথচ, সবাই জানে তোমাকে কেমন ঠকানো হবে। সুবিচারের জন্যে এমন জজের ওপর বিশ্বাস রাখো তুমি যে রাস্তায় রাস্তায় খদ্দের খুঁজে বেড়ানো বেশ্যার মত নিজেকে বেচে দেয়। একবার তুমি সর্বনেশে সুদের বিনিময়ে টাকা ধার করতে গিয়েছিলে ব্যাঙ্কে, দীন-হীন ফকিরের মত ওখানে গিয়ে বসে থাকতে হত তোমাকে দিনের পর দিন, ওরা তোমার পিছনটা কে গন্ধ নিয়ে বুঝতে চাইত টাকা শোধ করার ক্ষমতা তুমি রাখো কিনা!