চাতুর্যের সাথে তার অনুরোধ পেশ করতে শুরু করেছে বনাসেরা। আপনার স্ত্রীর ধর্ম-কন্যা, আমার মেয়ে এখানে এসে আজ আপনাদের পরিবারকে শ্রদ্ধা জানাতে পারল না, সেজন্যে তাকে আপনি ক্ষমা করবেন। হাসপাতালের বিছানায় এখন শুয়ে আছে সে। সনি কর্লিয়নি এবং টম হেগেনের দিকে তাকাল বনাসেরা। আশা করছে সে যে এদের সামনে কথাটা পাড়তে চাইছে না তা ডন কর্লিয়নি বুঝবেন। ডন সবই বুঝলেন। কিন্তু তাঁর দয়া হলো না।
তিনি বলেন, মেয়েটার দুর্ভাগ্যের কথা আমরা জানি। তার কোন সাহায্য আমার পক্ষে করা সম্ভব বলে মনে করলে, বলল। আর যাই হোক, আমার স্ত্রী তার ধর্ম-মা, সুতরাং আমার কাছে তার সম্মান কম নয়, এবং এই সম্মানের কথা আমি কখনও ভুলি না। ডনের এই কথাগুলোর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে বনাসেরার প্রতি তীব্র তিরস্কার। ডন কর্লিয়নিকে বনাসেরা আজ পর্যন্ত কখনও ধর্ম-পিতা বলে, সম্বোধন করেনি। অর্থাৎ প্রথম থেকেই একটা অবশ্য পালনীয় রীতি লঙ্ঘন করে আসছে বনাসেরা।
ডনের কথা শুনে কাগজের মত সাদা হয়ে গেল নাসেরার মুখ। দমে গিয়ে বলল, আপনার সাথে নির্জনে কথা বলার সৌভাগ্য হবে কি?
মাথা নাড়লেন ডন কর্লিয়নি। এদেরকে আমি নিজের মতই বিশ্বাস করি। এরা দুজন আমার দুটো হাত। এখান থেকে ওদেরকে যেতে বলা মানে ওদেরকে অপমান করা। তা আমি পারব না।
চোখ বুজে কি এক ধাক্কা সামলাল যেন বনাসেরা। তারপর চোখ খুলে, যেন মৃত ব্যক্তির আত্মীয়কে সান্তনা দিচ্ছে, রপ্ত করা নরম আর শান্ত গলায় কথা বলা শুরু করল।
মেয়েকে আমি আমেরিকান স্টাইলে মানুষ করেছি। তার কারণ, আমেরিকার ওপর আমার আস্থা আছে। এর মধ্যে যতটুকু সাফল্য অর্জন করেছি আমি, তা আমেরিকারই দান। মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছি সত্যি, তার সাথে এ-শিক্ষাও দিয়েছি যে কখনও যেন নিজেদের পরিবারকে কলঙ্কের মধ্যে না জড়ায়। একজন বয়-ফ্রেণ্ড, ইতালীয় নয়, তার সাথে সিনেমা টিনেমায় যেত ও। কিন্তু ছেলেটি কখনও আমার বা আমার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হবার জন্যে বাড়িতে আসেনি। কোন প্রতিবাদ না করে এ সবই আমি মেনে নিয়েছিলাম। এখানেই ভুল হয় আমার। যাই হোক, মাস দুই আগে ছেলেটা ওকে গাড়িতে করে বেড়াতে বেরিয়েছিল। সাথে ছিল আরেক ছোকরা। এরা দুজন মিলে জোরজার করে ওকে হুইস্কি খাইয়ে ওর চরিত্র নষ্ট করার চেষ্টা করে। ও রাজি হয়নি, বাধা দিয়েছিল। এবং নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। তখনই ওকে মার খেতে হয়। খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, মেয়েকে নিতে পারি না। দুচোখে কালসিটে। নাক ভেঙে গেছে। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে চোয়ালের হাড়। জোড়া লাগাবার জন্যে তার দিয়ে বাঁধতে হয়েছে। কথার মধ্যে কোন আবেগ না থাকলেও কথা শেষ হতেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল বনাসেরা।
অভদ্রতা দেখানো হয়ে যায় তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুহূর্তের জন্যে চেহারায় ক্ষীণ একটু সমবেদনার ভাব ফোঁটালেন ডন কর্লিয়নি।
বেদনায় নীল হয়ে গেছে বনাসেরার চেহারা। ও আমার একমাত্র মেয়ে, আমার চোখের আলো। ভারি সুন্দর দেখতে ছিল। সেই রূপ আর কখনও ফিরে পাবে না। বড় বেশি বিশ্বাস করত মানুষকে, আর কখনও করবে না। থরথর করে কাঁপছে শরীরটা।
ভাল মানুষ একজন আমেরিকান যা করে, আমিও তাই করলাম। পুলিশের কাছে গেলাম। পুলিশ ছেলে দুটোকে গ্রেফতার করল। কোর্ট তাদের বিচার করল। এত সাক্ষ্য, অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। অপরাধ স্বীকার করল ওরা। জজ ওদের সাজা দিলেন। তিন বছরের জেল। সাথে সাথে সাজা মাফও করে দিলেন। তখুনি ওরা ছাড়া পেয়ে গেল। বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। দুই হারামজাদা, তাদের মা বাবারা আমার দিকে ফিরে হাসতে লাগল। তখন আমার স্ত্রীকে জানালাম, সুবিচার পেতে হলে ডম কর্লিয়নির কাছে যেতে হবে।
লোকটার দুঃখের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে মাথাটা একটু নত করলেন ডন কর্লিয়নি। কিন্তু তার আত্মমর্যাদা যে আহত হয়েছে তা বোঝা গেল ঠাণ্ডা হিম কণ্ঠস্বর থেকে! কেন? পুলিশের কাছে যাওয়া হয়েছিল কেন? শুরুতেই আমার কাছে আসোনি কি মনে করে?
বিড় বিড় করে কি যেন বলল বনাসেরা, কেউই তা ভাল করে শুনতে পেল না। গলায় জোর এনে তারপর বলল, আপনি যা চান তাই দেব। আপনার ইচ্ছাটা শুধু আমাকে জানতে সুযোগ দিন। কিন্তু আমার আরজিটা গ্রহণ করুন-দয়া করে। কথাগুলো প্রায় ঔদ্ধত্যের মত শোনাল।
গম্ভীর হলেন ডন কর্লিয়নি। আরজিটা কি?
হেগেন আর সনির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল নাসেরা। ডেস্কের উপর হাতের ভর রেখে প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে পড়লেন ডন। একটু ইতস্তত করল বনাসেরা, তারপর নিচু হয়ে ডনের নোমশ কানের এত কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে গেল যে প্রায় ছোঁয়া লেগে যায় আর কি। এই মুহূর্তে গির্জার পাদ্রীর মত লাগছে ডনকে, গভীর মনোযোগে কোন পাপীর স্বীকারোক্তি গুনছেন যেন। তাকিয়ে আছেন যেন বহুদূরে, চোখে উদাস দৃষ্টি। দীর্ঘ এক মিনিট পর কথা শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল বনাসেরা। ডন ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। গভীর। মুখটা লাল হয়ে উঠল বটে, কিন্তু ভয় পেল না বনাসেরা। সেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডনের চোখের দিকে।
না, শেষ পর্যন্ত মুখ খুললেন ডন। এমন কাজ আমি করতে চাই না। তু আবেগে অন্ধ হয়ে গেছ।