সাথে করে নব-দম্পতির জন্যে উপহার নিয়ে এসেছে লুকা ব্রাসি। টাকা ভর্তি একটা খাম। কাঁপা হাতে সেটা সে ডন কর্লিয়নির দিকে বাড়িয়ে ধরল।
ডন কর্লিয়নির মধ্যে একটা পরিবর্তন চোখ এড়াল না হেগেনের। রাজাকে খুশি করার জন্যে কোন প্রজা যখন কোন মহৎ কাজ করে, রাজা তখন সেই প্রজাকে যেভাবে অভ্যর্থনা করেন, খুব ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতার সাথে নয়, বরং গাম্ভীর্যপূর্ণ রাজোচিত সম্মানের সাথে, ঠিক সেইভাবে ডন কর্লিয়নি অভ্যর্থনা করছেন লুকা ব্রাসিকে। তার প্রতিটি ভঙ্গির সাহায্যে, প্রতিটি বাক্যের সাহায্যে ডন কর্লিয়নি বুঝিয়ে দিলেন তাঁর কাছে লুকা ব্রাসি একটা অমূল্য সম্পদ। তিনি তাকে আর সবার চেয়ে বেশি মূল্য দেন। নিজের হাতে উপহারটি তাঁকে দেবার জন্যে তিনি মোটেও বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। সবই তিনি বুঝলেন। তিনিও শব্দের মণি মুক্তো দিয়ে তৈরি করা ভাষায় ৪ন্যবাদ জানিয়ে সামান্য এই আনাড়িপনাটুকু মাফ করে দিলেন।
হেগেন লক্ষ করছে, মুহূর্তে হিংস্র মুখোশটা খসে পড়ল লুকা ব্রাসির চেহারা থেকে, গর্ব আর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মুখ। এগিয়ে গেল হেগেন, দরজা খুলে দিয়ে অপেক্ষা করছে সে। লুকা ব্রাসি গড ফাদারের হাতে চুমো খাচ্ছে।
লুকা ব্রাসি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, বুদ্ধি করে হেগেন তার দিকে ফিরে ভেট হিসেবে বন্ধুত্বের হাসি উপহার দিল একটা। কিন্তু ব্রাসিকে সে হাসতে দেখল না। নীরস রবারের মত ঠোঁট দুটো একটু লম্বা হলো শুধু। হেগেনের জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট।
লুকা ব্রাসি বিদায় হতেই আপনা-আপনি বুকের ভিতর থেকে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ডন কর্লিয়নির। পৃথিবীর কোন লোককে সামান্যতম ভয়ও যদি তিনি করেন, তো সে এই লুকা ব্রাসি। এ লোক প্রচণ্ড একটা প্রাকৃতিক শক্তি, একে সংযত রাখা আসলেই সম্ভব নয়। লোকটাকে ডিনামাইট মনে করে খুব সাবধানে ঘাটেন তিনি। আপন মনে মৃদু কাঁধ ঝাঁকালেন ডন। ভাবলেন, প্রয়োজনে নিরাপদ বিস্ফোরণ তত ডিনামাইটেরও ঘটানো যায়। তারপর দৃষ্টিতে প্রশ্ন নিয়ে হেগেনের দিকে তাকালেন।
গড ফাদারের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে হেগেন বলল, জ্বী, আর শুধু আমেরিগো বনাসেরা বাকি আছে।
ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবলেন ডন কর্লিয়নি। তারপর বললেন, তার আগে সান্তিনোকে ডাকো। এসব কিছু কিছু তারও শেখা দরকার।
বাগানে বেরিয়ে এসেছে হেগেন। ব্যস্তভাবে এখানে সেখানে খুঁজে বেড়াচ্ছে সনিকে। বনাসেরার সাথে দেখা হয়ে গেল। তাকে একটু ধৈর্য ধরার উপদেশ খয়রাত করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল মাইকেল কর্লিয়নি আর তার বান্ধবীর দিকে।
সনিকে দেখেছ নাকি, মাইকেল?
মাথা নাড়ল মাইকেল।
শঙ্কিত হয়ে উঠল হেগেন। সনি কি তাহলে এখন সেই মেয়েটার সাথে রঙ তামাশায় মেতে আছে? একটা গোল না বাধিয়ে ছাড়বে না দেখছি! কেমন আক্কেল বাপু তোমার বৌ রয়েছে, ছুঁডীটার বাড়ির লোকজন রয়েছে, সব জানাজানি হয়ে গেলে সর্বনাশ হতে কিছু বাকি থাকবে? ভাবতে ভাবতে সদর দরজার দিকে হন হন করেএগোচ্ছে হেগেন। প্রায় আধঘন্টা আগে সনিকে ওদিকে যেতে দেখা গেছে।
হেগেন বাড়ির ভিতর ঢুকছে, তাই দেখে কে অ্যাডামস জানতে চাইল, আসলে কে ও? ভাই বলে পরিচয় তো করিয়ে দিলে, কিন্তু নামে মিল নেই, চেহারা দেখেও তো ঠিক ইতালীয় বলে মনে হচ্ছে না।
মাইকেল জানাল, ওর সেই বারো বছর বয়স থেকে এখানে আছে। মা-বাপ মরে গেল কিনা, কি আর করে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তাই দেখে সনি এক রাতে ওকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই থেকে আছে। কোন আশ্রয় ছিল না, বিয়ের আগে পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থাকত।
ঘটনাটা রোমাঞ্চকর লাগছে কে অ্যাডামসের। ঠিক যেন গল্প শুনছি। তোমার বাবার এত দয়া? নিজেরই এতগুলো ছেলেপিলে, তার ওপর আরেকজনকে পুষ্যি নিলেন?
চার সন্তানের পরিবারকে বহিরাগত ইতালীয়রা বড় পরিবার বলে মনে করে না, কিন্তু তা কেকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করল না মাইক। বলল, বাবা ওকে পুষ্যি নিয়েছেন, এ কথা আমি বলেছি? আমাদের সাথে এমনি থাকত।
ও, আচ্ছা, বলল কে। কিন্তু কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে সাথে সাথে আবার প্রশ্ন করল সে, কিন্তু পুষ্যিই বা নিলেম না কেন?
একটু হাসল মাইকেল। পুষ্যি নিলে তো নাম বদলাতে হয়, সেটা বাবা চাননি। তাতে ওর বাবা-মার প্রতি অসম্মান দেখানো হয়ে যায়।
হেগেন আর সনিকে দেখতে পাচ্ছে এখন ওরা। লম্বা কাঁচের দরজা দিয়ে ঠেলে ডনের অফিসে সনিকে ভিতরে ঢুকিয়ে আঙুল বাকিয়ে ডাকছে হেগেন আমেরিগো বনাসেরাকে।
আচ্ছা, জানতে চাইছে কে, এমন দিনে ওরা তোমার বাবাকে কাজের মধ্যে টেনে না আনলেই তো পারত!
আবার একটু হাসল মাইকেল। মজার একটা কারণ আছে এর মধ্যে।
কি? কৌতূহল উপচে পড়ছে কে-র দুচোখে।
ওরা জানে মেয়ের বিয়ের দিনটা এমন এক দিন, এই দিনে প্রার্থীকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না। এটা হলো একটা সিসিলীয় রীতি। কিছু চাওয়ার এমন সুযোগ সিসিলীর লোকেরা ছাড়ে কিভাবে, বলো?
.
গোলাপী গাউনটা মাটি থেকে একটু তুলে নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে লুসি ম্যানচিনি। একটু আগে দেখা সনি কর্লিয়নির কিউপিডের মত ভারি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মদ খেয়ে বিচ্ছিরী লাল করে ফেলেছে মুখটাকে, তার উপর উগ্র লালসার সীল মোহর পড়েছে। শিউরে উঠল লুসি,.ভয়ই করছে তার। কিন্তু, একথাও ভাবছে, এখন আর ভয় পেলে চলবে কেন গো মেয়ে! এই মজার আশাতেই না তুমি সারাটা হপ্তা ষাঁড়টাকে জ্বালাতন করে খেপিয়ে তুলেছ। এখন তার শিং দেখে ডরাও ক্যান?