এগুলোকেই যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে হয় তাহলে মনোবিজ্ঞানের বিবেচনা করতে হবে এই উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য কী করা যেতে পারে; বিশেষ করে বিবেচনা করতে হবে কতটা স্বাধীনতা সর্বাধিক কার্যকর প্রমাণিত হওয়া সম্ভবপর।
শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রশ্নে বর্তমানে তিনটি প্রধান মতবাদী গোষ্ঠী রয়েছে। এই তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে অংশত উদ্দেশ্যগত পার্থক্য রয়েছে, অংশত মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দিক থেকেও তফাত আছে। অনেকে বলে থাকেন শিশুদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, তারা যতই মন্দ স্বভাবের হোক না কেন; আবার অনেকে তাদের কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ অধীনে রাখার পক্ষে মত দেন, তারা যতই সচ্চরিত্র হোক না কেন। আরো এক গোষ্ঠীর অভিমত হলো তাদের স্বাধীনতা দেয়া উচিত, কিন্তু স্বাধীনতা দেয়া সত্ত্বেও তাদের সদাচারী হতে হবে এবং সবসময়ই। শেষোক্ত গোষ্ঠী বৃহত্তর হলেও এদের দাবির যৌক্তিকতা সামান্যই। বয়স্কদের মতোই সব শিশু যদি স্বাধীন হয় তবে পুণ্যবান হবে না। এই যে বিশ্বাস করা হয় স্বাধীনতা নৈতিক সম্পূর্ণতা নিশ্চিত করবে এটা রুশোবাদের ধ্বংসাবশেষমাত্র, পশু ও শিশুদের নিয়ে চর্চা করতে গেলে এই তত্ত্ব টিকবে। যারা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তাদের ধারণা হলো শিক্ষার কোনো সদর্থক উদ্দেশ্য থাকা উচিত নয়। শিক্ষা কেবল স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এ দলের সঙ্গে আমি ঐকমত্য পোষণ করি না, এই দলের মত অতিবেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং অযথা জ্ঞানের গুরুত্বের প্রতি উদাসীন। আমরা যে ধরনের সমাজে বাস করি সেখানে সহযোগিতার দরকার রয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত তাড়না থেকে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার সহযোগিতা সৃষ্টির প্রত্যাশা অসার কল্পনা মাত্র। সীমাবদ্ধ এলাকায় বিরাট জনগোষ্ঠীর বসবাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদেই কেবল সম্ভবপর: সুতরাং শিক্ষাদর্শকে প্রয়োজনেই যৎকিঞ্চিৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। যে সকল শিক্ষক সর্বাধিক স্বাধীনতা অনুমোদন করেন তাদের সাফল্য নির্ভর করে কিছুটা বদান্যতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রশিক্ষিত বুদ্ধির উপর, যা, যেখানে সকল আবেগ অনিয়ন্ত্রিত, সৃষ্টি হওয়া প্রায় অসম্ভব। সুতরাং তাদের গুণাবলি স্থায়িত্ব পেতে পারে না যদি তাদের পদ্ধতি হয় নির্জলা। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, শিক্ষাকে বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, কিছুটা সদর্থকও হতে হবে। আবার এটা যোগানোর পরও শিক্ষাকে অবশ্যই মানসিক ও নৈতিক মাধ্যমের যোগান দিতে হবে, কারণ শিশুরা নিজ থেকে এগুলো অর্জন করতে পারবে না।
শিক্ষায় বড় রকমের স্বাধীনতা প্রদানের পক্ষে যে যুক্তিগুলো খাড়া করা হয় তার উৎস মানুষের স্বাভাবিক সৎগুণ নয় বরং কর্তৃত্বের প্রতিক্রিয়া এবং এটা কেবল কর্তৃত্বের যারা শিকার তাদের বেলায় খাটে না, যারা কর্তৃত্ব খাটায় তাদের বেলায়ও সমানভাবে খাটে। যাদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে হয় তারা হয় অতি বাধ্য অথবা বিদ্রোহী, এবং এই দুটি মনোভাবেরই অনেক ত্রুটি রয়েছে।
অতি-বাধ্যরা উদ্যম হারিয়ে ফেলে, চিন্তা ও কর্ম, উভয় ক্ষেত্রে; উপরন্তু উদ্যমে ব্যাঘাত থেকে যে ক্রোধ জন্মে তা প্রকাশ পায় দুর্বলতরদের উপর খবরদারির ভেতর। এজন্যই নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বরচিত পথে চলে: যে লোক পিতা-কর্তৃক নিপীড়িত হয় সে পুত্রকে নিপীড়ন করে। পাবলিক স্কুলে গ্লানি অর্জনের স্মৃতি নিয়ে সাম্রাজ্য-নির্মাতা হলে নেটিভদের উপর তা চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা নড়ানো যায় না। এইভাবে অযথা কর্তৃবাদী শিক্ষা ছাত্রদের দুর্বলচিত্ত অত্যাচারীতে পরিণত করে, কথায় বা কাজে মৌলিকতা অর্জন করতে পারে না কিংবা সহ্য করার সমর্থতা লাভ করে না। শিক্ষকদের উপর এর প্রতিক্রিয়া আরো খারাপ হয়। তাদের মধ্যে ধর্ষকামী ও কঠোর নিয়মানুবর্তী হওয়ার ঝোঁক দেখা দেয়। সন্ত্রস্ত করতে পারলে তারা খুশি হয় এবং অন্যকিছু করে সন্তুষ্ট হয় না। এই লোকগুলো যেহেতু জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে ফলে ছাত্ররা অর্জন করে জ্ঞানাতংক, এবং ইংরেজ উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি একে মানব প্রকৃতির হিসেবে ধরে নেয়, অথচ বাস্তবে এটা কর্তৃবাদী পণ্ডিতদের বদ্ধমূল ঘৃণার অঙ্গ।
অপরদিকে বিদ্রোহীরা, যদিও তাদের দরকার রয়েছে, কমই ন্যায়ানুগ হয়। উপরন্তু বিদ্রোহ করার বহু উপায় রয়েছে, এবং বিদ্রোহীদের একটি ক্ষুদ্র সংখ্যার লঘু অংশ মাত্রই কেবল বিজ্ঞ। গ্যালিলিও একই সঙ্গে বিদ্রোহী এবং বিজ্ঞ ছিলেন; যারা সমতল পৃথিবীর তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তারাও সমানভাবে বিদ্রোহী, কিন্তু এরা নির্বোধ। প্রথাবিরুদ্ধ মতামত মাত্রেই সঠিক, এই ধরনের অনুমোদনের প্রতি ঝোঁক বিপজ্জনক। অর্থাৎ আলোকবাতির খুঁটি গুঁড়িয়ে দেয়া কিংবা শেক্সপিয়র কোনো কবিই নয় মনে করা কোনো উপকারে আসে না। অবশ্য এই ধরনের অতি-বিদ্রোহী মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে প্রাণবান ছাত্রদের উপর অতিরিক্ত কর্তৃত্ব খাটানোর প্রতিক্রিয়া। আর যখন বিদ্রোহীরা শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন অনেক সময় তারা ছাত্রদের অবাধ্য হতে উৎসাহিত করেন। আবার একই সঙ্গে ছাত্রদের জন্য নিখুঁত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেন, অথচ এই দুটি লক্ষ্য কিছুতেই সহাবস্থান করতে পারে না।