আমেরিকায় অনুরূপতার দিকে ঝোঁকের সঙ্গে, আমার মনে হয়েছে, গণতন্ত্র সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে গণতন্ত্রের জন্য দরকার সব মানুষকে একরকম হওয়া, এবং যদি কোনো ব্যক্তি অন্য একজন ব্যক্তি থেকে আলাদা হন তাহলে ধরা হয় তিনি নিজেকে ঐ ব্যক্তি থেকে উন্নততর বলে জাহির করছেন। ফ্রান্স আমেরিকার মতোই গণতান্ত্রিক অথচ ফ্রান্সে এ ধরনের মত পোষণ করা হয় না। ডাক্তার, উকিল, যাজক, সরকারি কর্মচারী সবাই ফ্রান্সে আলাদা ধরনের। প্রত্যেকটি পেশার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং মান রয়েছে, অথচ একটা পেশা অপরাপর পেশা থেকে উন্নততর বলে জাহির করা হয় না। আমেরিকার সকল পেশাজীবীই ব্যবসায়ী শ্রেণির মতো। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একজনের ডিক্রি জারি করা উচিত ঐকতানে শুধু কয়েকটি বেহালা থাকবে। এমন বোধ কারো মধ্যে কাজ করে না যে বাস্তবে সমাজ হবে একটা প্যাটার্নের মতো কিংবা প্রাণবান, যেখানে বিভিন্ন অঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করবে। কল্পনা করুন চোখ ও কান বিবাদ করছে কোনটা ভালো, দেখা না শোনা, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে যে কোনোটাই ভালো। কাজ করে না, যেহেতু এর কোনোটিই উভয় কাজ করতে পারে না। গণতন্ত্র সম্পর্কে আমেরিকায় এরকম ধারণাই পোষণ করা হয়। যে কোনো ধরনের চমত্তারিত্ব ব্যাপারে, যা সার্বজনীন হতে পারে না, অদ্ভুত ঈর্ষা বোধ করা হয়, তবে খেলাধুলার ক্ষেত্রে নয়, এখানে আভিজাত্য খুব উৎসাহের সঙ্গে প্রশংসা করা হয়ে থাকে। মনে হয় গড় মার্কিনীরা মস্তিষ্কের চেয়ে পেশির প্রতি বেশি বিনয়। কারণ হয়তো এই যে, তাদের মস্তিষ্কের চেয়ে পেশির প্রতি শ্রদ্ধা গভীরতর এবং বেশি আন্তরিক। আমেরিকায় বিজ্ঞানের জনপ্রিয় গ্রন্থের যে প্লাবন তার অনুপ্রেরণা, অংশত, যদিও অবশ্য গোটাটা নয়, এসেছে একথা স্বীকার করার অনিচ্ছা থেকে যে বিজ্ঞানে এমন কিছু আছে যা শুধু বিশেষজ্ঞরাই বুঝতে পারেন। ধরুন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বোঝার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে এমন ধারণাই ওদের কাছে বিরক্তিকর। আবার ওদের বলুন প্রথম শ্রেণির ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার করে, কেউ মোটেই বিরক্ত হবে না।
অর্জিত খ্যাতির প্রতি অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে আমেরিকায় বেশি শ্রদ্ধা দেখানো হয়, তবে তরুণদের জন্য এ ধরনের খ্যাতি অর্জনের পন্থা কঠিন করে তোলা হয়। কারণ জনগণ কোনো খামখেয়ালি সহ্য করতে পারে না, কিংবা যাকে বলা হয়। একজন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে এটা তাদের কাছে অসহ্য, অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ইতঃমধ্যেই প্রসিদ্ধ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকলে আলাদা কথা। ফলে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের তারা শ্রদ্ধা করলেও দেশে তৈরি করতে পারে না। ইউরোপ থেকে আমদানি করতে হয়। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রমিতকরণ এবং অনুরূপতা। অসাধারণ মেধা, বিশেষ করে শিল্পের ক্ষেত্রে, তরুণ বয়সে বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে বাধ্য। যতদিন সবার কাছে প্রত্যাশা করা হবে তারা সফল নির্বাহী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্যাটার্ন অনুসরণ করবে, ততদিন এর ব্যত্যয় হবে না।
অসাধারণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রমিতকরণ অসুবিধার কারণ হতে পারে, তবে সম্ভবত গড় মানুষের সুখ বৃদ্ধি করে। কারণ তারা তাদের চিন্তা এতটা নিশ্চয়তার সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারে যে তা যেন তার শ্রোতার চিন্তার অনুরূপ। উপরন্তু এটা জাতীয় সংহতির উন্নতি সাধন করে, এবং অন্যত্র মতভেদের পার্থক্য খুব বেশি হলেও এখানে রাজনীতি হয় কম তিক্ত। দাঙ্গাবাজ মনোভাবও কম হয়। আমি মনে করি না যে লাভ ও ক্ষতির মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু আমি মনে করি, আমেরিকায় আজ যে প্রমিতি লক্ষ্য করা যায়, তা গোটা ইউরোপে অচিরে দেখা দেবে জগৎ আরো যন্ত্রনির্ভর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে। অতএব যে সব ইউরোপীয় ভদ্রলোক এক্ষেত্রে আমেরিকার ক্রটি দেখতে পান তাদের উপলব্ধি করা উচিত যে তারা তাদের দেশে ভবিষ্যৎ ব্যাপারে অনুরূপ ত্রুটি দেখতে পাবেন। এক্ষেত্রে আমেরিকার ত্রুটি দেখতে পাওয়ার অর্থ হলো সভ্যতার অনিবার্য এবং সার্বিক ঝোঁকের প্রতিকূলে নিজেদের দাঁড় করানো। নিঃসন্দেহে জাতিসমূহের মধ্যে প্রভেদ হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আন্তর্জাতিকতা সহজতর হয়ে আসবে এবং একবার আন্তর্জাতিকতা প্রতিষ্ঠিত হলে অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষায় সামাজিক সংহতির গুরুত্ব খুবই বেড়ে যাবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে শেষের দিকের রোমক সাম্রাজ্যের মতো অচলাবস্থা সৃষ্টির ঝুঁকি এতে থেকে যায়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমরা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈপ্লবিক শক্তি কাজে লাগাতে পারি। সার্বিক বুদ্ধিগত অবক্ষয় না-ঘটলে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যা আধুনিক জগতের নতুন বৈশিষ্ট্য, অচলাবস্থা অসম্ভব করে তুলবে এবং সেই ধরনের স্থবিরতা ঠেকিয়ে রাখবে যা ইতিহাসের অনেক সাম্রাজ্য গ্রাস করেছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে ইতিহাসের যুক্তি প্রয়োগ বিপজ্জনক, কারণ বিজ্ঞান সূচনা করেছে সম্পূর্ণ পরিবর্তন। অতএব আমি অযথা নৈশ্যবাদী হওয়ার কোনো যুক্তি দেখি না, প্রমিতকরণ অনভ্যস্ত ব্যক্তিদের রুচিকে যতই আঘাত করুক না কেন।
১১. মানুষ বনাম কীট-পতঙ্গ
যুদ্ধ এবং যুদ্ধের গুজবের ভেতর, যেখানে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি এবং অনাক্রমণ চুক্তি মানব বংশের প্রতি অভূতপূর্ব হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে অপর একটি দ্বন্দ্ব, হয়তো সমধিক গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনের চেয়ে কম মনোযোগ কাড়ছে। আমি এখানে মনুষ্য ও কীট-পতঙ্গের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটা বোঝাচ্ছি।