মায়েদের ক্ষতির দিকটাও খুব গুরুতর। তাকে একই সঙ্গে নার্স, রাঁধুনি এবং পরিচারিকার কাজ করতে হয়, এবং এর একটি কাজের জন্যও সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। অনিবার্য কারণেই সে একটি কাজও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। সে সব সময় ক্লান্ত থাকে এবং সন্তানদের দেখে সুখানুভব করার চেয়ে বরং বিরক্তিই বোধ করে। কাজ শেষে তার স্বামী অবসর ভোগ করে। কিন্তু তার অবসর নেই; পরিশেষে অনিবার্য কারণেই তার মেজাজ হয় খিটখিটে, সংকীর্ণ-মনা এবং ঈর্ষাকাতর।
স্বামীর অসুবিধা একটু কম, কারণ সে বাড়িতেই থাকে কম। কিন্তু সে যখন বাড়িতে থাকে তখন নিশ্চয়ই স্ত্রীর অসন্তুষ্ট স্বভাব কিংবা সন্তানের অসৎ আচরণ উপভোগ করে না। যেখানে তার অভিযুক্ত করা উচিত স্থাপত্যকর্মকে সেখানে সে অভিযুক্ত করে স্ত্রীকে, ফলশ্রুতি দাঁড়ায় দুঃখজনক, এই দুঃখজনক ফলশ্রুতির হেরফের ঘটে তিনি কতটা পাশবিকতা করতে পারেন তার তুলনায়। এ ধরনের ব্যবস্থা ত্রুটিহীন হয়ে যায় না যদি অঘটনের সংখ্যা বিরল হয়ে যায়।
আমি অবশ্যই বলছি না যে এটা সার্বজনীন ব্যাপার, এবং সব ক্ষেত্রেই ঘটে, কিন্তু আমি বলি যে, যখন ঘটে না তখন দরকার অতিরিক্ত মাত্রায় আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, প্রজ্ঞা, এবং মায়ের দৈহিক শক্তি। স্পষ্টতই সে ব্যবস্থা মানুষের ভেতর এতটা গুণাবলি দাবি করে যে তা কেবল ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই সফল হয়।
এইসব অসুবিধা একযোগে দূর করার জন্য দরকার স্থাপত্যকর্মে সামষ্টিক উপাদান সূচিত করা। পৃথক ক্ষুদ্র বাড়ি, রান্নাঘরসহ বস্তির সারি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তদস্থলে সারি সারি উঁচু দালান কেন্দ্রীয় চতুর্ভুজ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকবে, দক্ষিণ দিকটা নিচু রাখতে হবে সূর্যালোক প্রবেশের জন্য। একটা সাধারণ রান্নাঘর থাকবে, প্রশস্ত ভোজন-কক্ষ, একটা বৃহৎ ঘর থাকবে আমোদ-প্রমোদ, সভা সমিতি এবং সিনেমা দেখার জন্য। কেন্দ্রীয় চতুর্ভুজে থাকবে একটা নার্সারি স্কুল এবং তা এমনভাবে নির্মিত হতে হবে যাতে বাচ্চারা নিজেদের ক্ষতি করতে না পারে, সহজ-ভঙ্গুর সামগ্রীও নষ্ট না। করতে পারে। কোনো সিঁড়ি থাকতে পারবে না, খোলা জায়গায় আগুন থাকে না কিংবা উত্তপ্ত স্টোভ থাকবে শিশুদের নাগালের বাইরে; থালা-বাসন, কাপ, পাতিল তৈরি হতে হবে অভঙ্গুর সামগ্রী দিয়ে। এবং সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে এমন ব্যাপার এড়িয়ে চলার যাতে বাচ্চাদের উঠতে-বসতে এটা করো না, ওটা করো না বলতে না হয়। আবহাওয়া ভালো থাকলে নার্সারি স্কুল বসবে খোলা আকাশের নিচে, আবহাওয়া খারাপ হলে, এমন কক্ষে স্কুল বসবে যার একটি অংশ বায়ু চলাচলের জন্য ভোলা। ওরা আহার-পর্ব সারবে নার্সারি স্কুলে, স্কুল খুব সস্তায় স্বাস্থ্যোপযোগী খাবার সরবরাহ করতে পারবে, যা ওদের মায়েদের পক্ষেও সরবরাহ করা সম্ভব নয়। ছাত্র থাকাকালে তারা প্রাতঃরাশ থেকে রাত্রির শেষ আহার গ্রহণ পর্যন্ত গোটা সময়টা স্কুলেই কাটাবে। এখানে তাদের আমোদ ফুর্তির প্রচুর সুযোগ মিলবে। তাদের নিরাপত্তার জন্য দরকার করবে ন্যূনতম তদারকি।
এতে বাচ্চাদের প্রচুর লাভ হবে, তাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে মুক্ত বাতাস, রোদ, প্রশস্ত পরিসর এবং ভালো খাবারের জন্য। চরিত্র উন্নত হবে স্বাধীনতা এবং বিরামহীন কুঁদুলে বিধিনিষেধের আবহ থেকে মুক্ত থাকার জন্য। অধিকাংশ শ্রমজীবী বাড়ির আবহ ঐ রকমই হয়। চলাফেরার স্বাধীনতা, যা কেবল কিশোর বয়সীদের নিরাপদে অনুমোদন করা যায় বিশেষভাবে গঠিত পরিবেশে, তা নার্সারি স্কুলে হবে নির্বাধ, এতে ফল হবে যে ওরা অভিযান প্রিয় হবে, ওদের পেশির দক্ষতা বিকশিত হবে স্বাভাবিকভাবে, যেমন সমবয়সী প্রাণীকুলের মধ্যে দেখা যায়। কিশোরদের চলাফেরায় সব সময় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তারা অসন্তুষ্ট হয় এবং পরবর্তী জীবনে হয় দুর্বলচিত্ত; তবে তাদের যদি বয়স্কদের মধ্যে থাকতে হয় তাহলে বিধিনিষেধ অনিবার্য হয়ে পড়ে; সুতরাং নার্সারি স্কুল একই সঙ্গে তাদের চরিত্র ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি হবে।
মহিলাদেরও বিরাট সুবিধা হয়। শিশু মাতৃক্রোড় ত্যাগ করার পর থেকেই তারা পুরোদিনের জন্য এমন মহিলাদের তদারকিতে থাকবে যারা উক্ত কাজের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। মায়েদের খাদ্য ক্রয়ের দায়িত্ব থাকবে না, রান্না করার না, বাসন-কোসন ধোয়ার না। তারা কাজের জন্য সকালে বেরিয়ে পড়বে, ফিরবে সন্ধেয়। তাদের স্বামীদের মতোই। স্বামীদের মতোই তাদের একটা সময় থাকবে কাজের, একটা সময় অবসর ভোগের। তাদের সব সময় ব্যস্ত থাকতে হবে না। তারা সকালে ও সন্ধেয় সন্তানের দেখা পাবে। হেবর্ষণের জন্য পাবে যথেষ্ট সময়, আবার তা স্নায়ুতে চাপ পড়ার জন্য যথেষ্ট হবে না। যে মায়ের সারাদিন কাটে সন্তানের সঙ্গে তার কৃচিৎ অতিরিক্ত বল থাকে তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করার; আসলে মায়ের চেয়ে বাপই বেশি সন্তানের সঙ্গে খেলাধুলা করে। সত্যি বলতে কি, অত্যন্ত স্নেহশীল বয়স্ক ব্যক্তিও বাচ্চাদের প্রতি বিরক্ত হবেন যদি তিনি বিরামহীন মনোযোগের দাবি থেকে মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম না পান। কিন্তু আলাদাভাবে দিন কাটলে সন্ধেবেলা মা-সন্তান উভয়ে অধিক স্নেহ অনুভব করবে। সারাদিন একসঙ্গে থাকলে যা সম্ভব নয়। দৈহিকভাবে ক্লান্ত কিন্তু মনের দিক থেকে প্রশান্ত সন্তান নার্সারি স্কুলের মহিলার নিরপেক্ষ যত্নের পর মায়ের সেবা অধিক উপভোগ করবে। পারিবারিক জীবনের যা-কিছু ভালো তা টিকে থাকবে, স্নেহমমতার উদ্বেগজনক এবং ধ্বংসাত্মক ব্যাপারটা ছাড়াই।