মধ্যযুগের সমাজের জটিলতার কাঠামো সত্ত্বেও স্থাপত্যকর্মে শৈল্পিক দৃষ্টি অনুরূপভাবে সীমাবদ্ধ ছিল, বাস্তবিকপক্ষে আরো এ কারণে যে, বড় মানুষের গৃহ নির্মিত হতে সামরিক শক্তির কথা ভেবে, এবং ঐ গৃহসমূহের কোনো সৌন্দর্য থাকলে সেটা ছিল আকস্মিক ঘটনা। সামন্তপ্রথা নয়, গির্জা ও বাণিজ্যই মধ্যযুগের বৃহৎ অট্টালিকাগুলো নির্মিত হওয়ার কারণ। ক্যাথিড্রালগুলো মেলে ধরেছে সৃষ্টিকর্তা এবং তার বিশপদের মহিমা। ইংল্যান্ড এবং লো কান্ট্রিসের মধ্যে পশমের ব্যবসায়ীদের জানা ছিল যে ইংল্যান্ডের রাজা এবং বারগান্ডির ডিউক বেতনভুক লোক মাত্র এবং তাদের গরিমা প্রকাশ করেছে চমৎকার ক্লথ হল এবং ফ্লারের পৌরসভার অট্টালিকায়, একটু কম জাঁকজমকের সঙ্গে ইংরেজ দোকান বীথিতে। কিন্তু আধুনিক ধনিকতন্ত্রের জন্মস্থান ইতালি বাণিজ্যিক স্থাপত্যশিল্পকে সম্পূর্ণতা প্রদান করে। সাগরকনে ভেনিস, যে নগরী। ধর্মযুদ্ধকে অন্য পথে চালিত করে এবং খ্রিস্টিয় রাজাদের মধ্যে সঞ্চার করে ভীতির, Doges Place ও বণিক রাজকুমারদের প্রাসাদে সৃষ্টি করে নতুন এক ধরনের জাঁকালো সৌন্দর্য। উত্তরের গ্রাম্য ব্যারনদের মতো ভেনিস ও জেনোয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নির্জনতা কিংবা সুরক্ষিত প্রাকারের দরকার ছিল না। বরং তারা পাশাপাশি বাস করেছে এবং এমন নগরী তৈরি করেছে যা ততটা অনুসন্ধিৎসু নয় এমন আগন্তুকের কাছে যা-কিছু দৃশ্যমান তা চমৎকার এবং নান্দনিক বিচারে সন্তোষজনক ছিল। ভেনিসে অপরিচ্ছন্নতা ঢেকে রাখা ছিল সহজ; নোংরা বস্তিগুলো পেছনের গলিতে লুকিয়ে থাকত এবং গন্ডোলা (ভেনিসের হালকা নৌকা-অনু.) ব্যবহারকারীরা তা কখনো দেখতে পেতেন না। ধনিকতন্ত্র এতটা পূর্ণ ও নিখুঁত সাফল্য আর কখনো অর্জন করতে পারে নি।
মধ্যযুগে গির্জাগুলো শুধু ক্যাথিড্রাল নির্মাণ করে নি, আরো এক ধরনের দালান নির্মাণ করেছে যা আধুনিক প্রয়োজনের জন্য সমধিক উপযোগী ছিল; মঠ, সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীদের জন্য আশ্রম এবং কলেজ। এসবের ভিত্তি ছিল সীমাবদ্ধ প্রকৃতির সাম্যবাদ, লক্ষ্য ছিল শান্তিপ্রিয় সামাজিক জীবন। এই দালানগুলোর যা-কিছু ব্যষ্টিক তা ছিল স্পার্টান এবং সাধাসিধে, গোষ্ঠীগত হলে হতো চমৎকার এবং অতি-পরিসরের। সন্ন্যাসীরা ক্ষুদ্র কুঠুরীতে মাথা গুজতে পেরেই সন্তুষ্ট থাকতেন; সংগঠনের গরিমা প্রকাশ পেত বৃহৎ হল-ঘর, চ্যাপেল এবং ভোজন কক্ষের জাঁকজমকে। বিলেতে সন্ন্যাসীর আশ্রম ও মঠগুলো প্রধানত টিকে আছে ধ্বংসস্তূপ হিসেবে পর্যটকদের আনন্দ দানের জন্য। তবে অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজের কলেজগুলো এখনও জাতীয় জীবনের অঙ্গ, এবং মধ্যযুগীয় গোষ্ঠীতন্ত্রের সৌন্দর্য ধারণ করে আছে।
উত্তরাঞ্চলে রেনেসাঁস ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের অভব্য ব্যারনরা মনোযোগ দেয় ইতালির ধনিক শ্রেণির চাকচিক্য অর্জনের জন্য। মেডিসির কন্যাদের বিয়ে দেয়া হতো রাজা, কবি এবং চিত্রকরদের সঙ্গে, আর আলপসের উত্তরের স্থাপত্যশিল্পীরা অনুকরণ করেছে ফ্লোরেন্সের মডেল, অভিজাতরা সুরক্ষিত প্রাসাদের বদলে পল্লিতে তৈরি করেছে বাড়ি-ঘর, যা, আক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষার অবর্তমানে, চিহ্নিত হয়েছে মার্জিত ও সভ্য লোকদের নতুন ধরনের নিরাপত্তা হিসেবে। তবে এই নিরাপত্তা ফরাসি বিপ্লবের জন্য বিনষ্ট হয়ে যায় এবং তখন থেকে প্রথাগত স্থাপত্যশৈলী তার প্রাণ হারিয়েছে। এসব এখনও কোথাও কোথাও টিকে আছে যেখানে পুরোনো ধরনের ক্ষমতা বিদ্যমান, যেমন লুর্ভে নেপোলিয়নের সংযোজন। তবে এই সব সংযোজনের রয়েছে বাহুল্যপূর্ণ আলংকারিক কদর্যতা, যা থেকে তার নিরাপত্তাহীনতার প্রমাণ মেলে। মনে হয় তিনি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর মাতার বাজে ফরাসি ভাষায় বার-বার মন্তব্য: Pourvou que cela doure.
ঊনবিংশ শতাব্দীর স্থাপত্যকর্ম ছিল দুধরনের, যন্ত্রে উৎপাদন এবং গণতান্ত্রিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ এর কারণ; একদিকে ধুয়া নিঃসরণের চিমনিযুক্ত কারখানা, অপরদিকে শ্রমজীবী পরিবারসমূহের জন্য ক্ষুদ্রাকৃতি গৃহের সারি। ফ্যাক্টরিগুলো যেখানে প্রতিনিধিত্ব করেছে শিল্পায়নের দরুন সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংগঠন সেখানে ক্ষুদে বাড়িগুলো প্রতিনিধিত্ব করেছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার, যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী জনগোষ্ঠীর আদর্শ। যেখানে ভূমির উচ্চ ভাড়ার হারের জন্য বহুতলাবিশিষ্ট দালান কাক্ষনীয়, তাদের রয়েছে সামাজিক নয় স্থাপত্যগত ঐক্য: সেখানে সারি সারি অফিস, এক দালানে অনেক বাড়ি, হোটেল, এবং এখানে যারা বাস করেন তারা আশ্রমের সন্ন্যাসীদের মতো গোষ্ঠী গঠন করেন না, বরং যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেন একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অসচেতন থাকার। ইংল্যান্ডের যেখানে ভূমির দাম খুব বেশি নয় সেখানে প্রতিটি পরিবারের জন্য পৃথক বাড়ির নীতি পালিত হয়। রেলপথে লন্ডন কিংবা উত্তরাঞ্চলের কোনো শহরে আসতে একজন দেখতে পাবেন সারি-সারি ছোট-ছোট বাড়িঘর। এর প্রতিটি বাড়ি ব্যক্তিজীবনের কেন্দ্র, গোষ্ঠীজীবনের প্রতিনিধিত্ব করে অফিস, কারখানা কিংবা খনি (কয়লা বা লোহার), জায়গার চরিত্র অনুসারে। পরিবারের বাইরের সামাজিক জীবন হবে একান্তভাবেই অর্থনৈতিক এবং অ-অর্থনৈতিক সকল সামাজিক প্রয়োজন পরিবারের মধ্যেই মেটাতে হবে কিংবা অপূর্ণ থেকে যাবে। কোনো সময়ের সামাজিক আদর্শ যদি তার স্থাপত্য গুণ দ্বারা বিচার করতে হয় তাহলে বলা যায় গত একশো বছরে কিছুই অর্জিত হয়নি।