আমাদের আচরণে অত্যন্ত নগ্নভাবে এ ধরনের ক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে সরাসরি পশুর প্রতি। এখানে অনুভূত হচ্ছে না ছলনা বা গোপনীয়তার প্রয়োজন। যখন শূকরের শরীরে রশি বেঁধে জাহাজে ওঠানো হয় এবং যখন সে আর্তনাদ করতে থাকে তখন সে সততই শারীরিক ক্ষমতার অধীন। আমাদের ইচ্ছানুসারে গাধা যখন গাজরকে অনুসরণ করে তখন এই যুক্তিদিয়েই তাকে আমরা কাজে উদ্বুদ্ধ করি যে, এমন করাই তার স্বার্থের অনুকূল। ক্রীড়া প্রদর্শনকারী পশুর আচরণ হচ্ছে এ দুয়ের মধ্যবর্তী, যার ভেতর অভ্যাস সৃষ্টি করা হয়েছে পুরস্কার ও শাস্তির মাধ্যমে। ভেড়ার জাহাজ আরোহণ আবার ভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ; এক্ষেত্রে জাহাজের খোলা জায়গায় নেতাকে টেনে বার করা হয়, তখন বাকিগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুসরণ করে তাকে।
উদাহরণসহ এরকম ক্ষমতাই মানব সমাজে ব্যাখ্যা করা যায়। মিলিটারি ও পুলিশি ক্ষমতার ব্যাখ্যাস্বরূপ, শূকরের দৃষ্টান্তটির বর্ণনা।
প্রচারণা ক্ষমতার স্বরূপ বর্ণনা করে গাধা ও গাজরের দৃষ্টান্ত।
শিক্ষার ক্ষমতা প্রদর্শিত হয় ক্রীড়া প্রদর্শনকারী পশুর উদাহরণে।
ভেড়াগুলো কর্তৃক তাদের অনিচ্ছুক নেতার অনুসরণ–দলীয় রাজনীতির দৃষ্টান্ত; যখন দলীয় কোন্দলের শিকার অথবা দলীয় নেতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ সাধারণ সম্মানিত নেতা।
আমরা এখন এই উপমাগুলো প্রয়োগ করি হিটলারের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে। গাজর চিল নাজি কর্মসূচি (সুদ উচ্চেদ সংবলিত), গাধা ছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোক, ভেড়া ও তাদের দলপতি ছিল সামাজিক গণতন্ত্র এবং হিন্দেনবার্গ। শূকরগুলো ছিল (শুধু তাদের ভাগ্য বিবেচিত হলো) বন্দিশিবিরে আটকেপড়া হতভাগ্যরা, ক্রীড়া প্রদর্শনকারী পশুগুলো হলো লাখ লাখ জনতা, যার বাধ্য নাজিকে সালাম দিতে।
বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন ক্ষমতা আরোপ করে থাকে। সংগঠনগুলোকে চিহ্নিত করা যায় এই আরোপিত ক্ষমতার রূপ অনুয়ায়ী। দৈহিক দমনমূলক ক্ষমতা অনুশীলন করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। পুরস্কার অথবা শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোতে। এর ফলে কাজের প্রতি উৎসাহ বা ভয় সৃষ্টি হয়। মতামত প্রভাবিত করার লক্ষ্য স্থির করে রাজনৈতিক দল। কিন্তু খুব স্পষ্ট নয় এই পার্থক্যগুলো, কারণ বৈশিষ্ট্যসূচক ক্ষমতার বাইরে প্রতিটি সংগঠনে ব্যবহার করা থাকে ভিন্ন ধরনের ক্ষমতাও।
এসব জটিলতার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আইনের ক্ষমতায়। আইনের ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় দমননীতি কার্যকর করে এর চূড়ান্ত রূপ। সভ্য সমাজে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হচ্ছে সীমাবদ্ধতা সাপেক্ষে দৈহিক দমন এবং কতগুলো নীতির সমাহার হচ্ছে আইন, যা অনুসরণ করে রাষ্ট্র এই বিশেষ অধিকার প্রযোগ করে নাগরিকদের সঙ্গে আচরণের মাধ্যমে। আইনে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। শুধু অনভিপ্রেত কার্যকলাপ বাস্তবে অসম্ভব করে তোলা এই শাস্তি বিধানের উদ্দেশ্য নয়, বরং তা অনাকর্ষণীয় করে তোলা। আইন প্রায় নিষ্ক্রিয়, যদি জনসমর্থন না থাকে। আমেরিকাতে নিষিদ্ধকালীন সময়ে অথবা আশির দশকে আয়ারল্যান্ডে তা দেখা যায় যখন অধিকাংশ জনগণের সহানুভূতি অর্জন করে Moonlighter রা। সুতরাং কার্যকরি শক্তি হিসেবে পুলিশি ক্ষমতার চেয়ে জনগণের মতামত ও আবেগের উপর আইন অধিকতর নির্ভরশীল। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।
আমাদের অতিপ্রয়োজনীয় ঐতিহ্যগত ও নবঅর্জিত ক্ষমতার মধ্যবর্তী পার্থক্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে এই হৃদয়ানুভূতি। অভ্যাসজনিত শক্তি বিদ্যমান ঐতিহ্যগত ক্ষমতার মধ্যে। প্রয়োজন নেই সবসময় এর সত্যতা বিচারের। বারবার প্রমাণেরও প্রয়োজন নেই যে একে উৎখাত করার মতো যথাযথ ক্ষমতার অধিকারী নয় কোনো প্রতিযোগীই। যদি তা জড়িত ধর্মবিশ্বাস ও প্রায় ধর্মবিশ্বাসের সাথে। ফলে খারাপ বলে বিবেচিত হয় প্রতিবন্ধকতা এবং বিপ্লবী ক্ষমতা বা জোরপূর্বক অর্জনের ক্ষমতার চেয়ে জনগণের মতামতের উপর অধিক নির্ভরশীল। এর পরস্পর বিপরীত দুটো পরিণতি বিদ্যমান। ঐতিহ্যগত ক্ষমতা একদিকে নিরাপত্তাবোধের জন্য বিশ্বাসঘাতক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল নয়, সম্ভবত অত্যধিক রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতা এড়াতে পারে ঐতিহ্যিক ক্ষমতা; অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের আসক্তির অনুকূলে স্মরণাতীত প্রথার যুক্তি রয়েছে সে সমাজে যেখানে প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান। আর এ জন্যই তা অধিকতর স্পষ্ট থাকে জনপ্রিয় সমর্থন লাভে আশাবাদী নতুন ধরনের সরকারের অধীন সম্ভাব্য অন্যায়গুলোর চেয়ে। ফ্রান্সের সন্ত্রাসী শাসন বিপ্লবী ধরনের কিন্তু সেটি করভি প্রথাজাতীয় অত্যাচারী শাসনের দৃষ্টান্ত।
আমার মতে যে ক্ষমতা ঐতিহ্য বা অনুমোদন নির্ভর নয় তা-ই নগ্ন ক্ষমতা। ঐতিহ্যগত ক্ষমতা ও নগ্ন ক্ষমতার ভেতর বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পার্থক্য অনেক। ঐতিহ্যগত ক্ষমতা বিদ্যমান যে সমাজে, সেখানকার শাসন বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে প্রায় সীমাহীন নিরাপত্তা অথবা নিরাপত্তাহীন অনুভূতির উপর।
নগ্ন ক্ষমতা স্বভাবতই সামরিক এবং তা দেখা দিতে পারে অভ্যন্তরীণ নিষ্ঠুরতা অথবা ভিন্ন দেশ বিজয়ের মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে নগ্ন ক্ষমতার গুরুত্ব বিদেশ জয়ে অনেক বেশি এবং আমি মনে করি তা অনেক বৈজ্ঞানিক ইতিহাসবিদের স্বীকৃত গুরুত্বের চেয়েও অনেক বেশি। মহান আলেকজান্ডার ও জুলিয়াস সিজার ইতিহাসের গতিধারার আমুল পরিবর্তন করেন যুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু পূর্বোক্ত ব্যক্তির জন্য গ্রিক ভাষায় লেখা হয়নি গসপেল এবং রোমান সাম্রাজ্যব্যাপী প্রচার করা যায়নি খ্রিস্টবাদ। শেষোক্ত ব্যক্তির জন্য ফরাসিরা ল্যাটিন থেকে উদ্ভূত ভাষায় কথা বলত না এবং ক্যাথলিক চার্চ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে সামান্যই। তলোয়ারের ক্ষমতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত রেড ইন্ডিয়ানদের উপর শ্বেতকায় মানুষদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব। সভ্যতার যে প্রসার ঘটে অস্ত্রবলের বিজয়ের মাধ্যমে, তা সম্ভব নয় কোনো একক কর্তৃত্বের পক্ষে। তা সত্ত্বেও অন্যান্য ক্ষমতার উপর সামরিক ক্ষমতা নির্ভরশীল, যেমন-স্বাস্থ্য, কৌশলগত জ্ঞান। সব সময় যে তা-ই ঘটেছে আমি তা বলছি না উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত স্পেনের যুদ্ধে ফলাফলের জন্য অপরিহার্য ছিল মার্লবরাফের প্রতিভা। কিন্তু একে বিবেচনা করতে হয় সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বলে।