এর দুটো গুণের বিস্তৃতির জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রের সফলতার। প্রথম দৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয় এ দুয়ের প্রবণতা। কিন্তু মানুষ অবশ্যই কিছুটা স্বনির্ভর হবে এবং নিজের বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করবে। বিপরীতমুখী রাজনৈতিক প্রচারণা থাকবে বহুলোকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কিন্তু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অধিকাংশ লোকের সিদ্ধান্ত অবশ্যই মেনে নিতে হবে। এই শর্তগুলোর যে কোনোটি ব্যর্থ হলে জনগণ অতিমাত্রায় অধীনতাপরায়ণ হয়ে একনায়কত্বের পথ সুগম করে দিতে পারে কোনো শক্তিশালী নেতাকে অনুসরণ করে। অথবা অতিশয় আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে জাতিকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিতে পারে প্রত্যেক দলই।
এ বিষয়ে দুটো শিরোনামে শিক্ষার কার্যকারিতা আলোচিত হতে পারে; প্রথমত আবেগ ও বৈশিষ্ট্যসাপেক্ষ; দ্বিতীয়ত শিক্ষাদানসাপেক্ষ। আরম্ভ করা যাক পূর্বোক্তটি দিয়েই।
জনসাধারণকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা ও ধ্বংস থেকে মুক্ত হতে হবে কার্যকরি গণতন্ত্রের জন্য। তাদেরকে হতে হবে ভয় ও অধীনতামুক্ত। এসব অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। কিন্তু আমি আলোচনা করব যেসব অনুভূতি সৃষ্টিতে শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে ওইগুলো।
ছেলেমেয়েদের পরিপূর্ণ বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কিছু স্কুল ও কিছু পিতামাতা প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এই প্রচেষ্টা দাস অথবা বিদ্রোহী সৃষ্টি করতে বাধ্য। এর কোনোটিই কাম্য নয় গণতন্ত্রে। কঠোর শৃঙ্খলাভিত্তিক শিক্ষার পরিণতি সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ইউরোপের সব একনায়কের অনুরূপ। যুদ্ধের পর ইউরোপের প্রায় সব দেশেই গড়ে ওঠে কিছু সংখ্যক মুক্ত স্কুল। ওইসব স্কুলে অস্তিত্ব নেই কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা। কিন্তু সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রসমেত সব সামরিক স্বৈরতন্ত্র স্কুলের স্বাধীনতা হরণ করে এবং পুরনো কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় ফিরে যা। এভাবে শিক্ষকদের দেখতে শুরু করে ক্ষুদ্রে ফুয়েরার বা ডুচ হিসেবে। আমরা ধরে নিতে পারি যে, সব একনায়কই স্কুলের স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে মনে করে। তারা আরও মনে করে যে, রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্রের ভূমিকা স্বরূপ স্কুলের স্বৈরতন্ত্র।
দাস বা বিদ্রোহী হওয়া উচিত নয় গণতন্ত্রের প্রতিটি পুরুষ বা নারী কারোই। তারা প্রত্যেকই নাগরিক অর্থাৎ এমন একজন মানুষ যিনি নিজে যেমন মানসিকতা পোষণ করেন অন্যকেও একই মানসিকতা পোষণ করার সুযোগ দান করেন। গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই যেখানে সেখানে সরকার অবতীর্ণ হন প্রভুর ভূমিকায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে সবার ভেতর সহযোগিতা বিদ্যমান। প্রত্যেকেই এখানে নিজের মতামতের গুরুত্ব আরোপ করে বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত, কিন্তু তার চেয়ে বেশি নয়।
এর ফলে আমরা গণতন্ত্রীদের কাছে পৌঁছে যাই নীতি নামক একটি অসুবিধার উৎসের কাছাকাছি। অনেকেই সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নীতি, আত্মত্যাগ ইত্যাদির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত বলে থাকেন। অল্প মাত্রার মনোসমীক্ষণ থেকে প্রতীয়মান হবে যে, এই সুন্দর সুন্দর শব্দ দ্বারা যা বোঝা যায় প্রকৃত ব্যাপার এর থেকে ভিন্ন। আদর্শবাদের মহান রূপে মূর্ত হয়ে উঠেছে অহংকার, ঘৃণা অথবা প্রতিশোধস্পৃহা। একজন যুদ্ধবাজ দেশপ্রেমিক দেশের জন্য যুদ্ধ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারেন বটে, কিন্তু তিনি নরহত্যায় বিশেষ আনন্দ পেলে তাকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই সন্দেহ করা যেতে পারে। ওই বিশেষ ধরনের আদর্শবাদী দেশপ্রেম বা শ্রেণি সগ্রামের মনোবৃত্তি জন্ম নেবে না শিশুকালে কৃপাপ্রাপ্ত সুখি ও যৌবনে বিশ্বের বন্ধুত্বপ্রাপ্ত সদাশয় জনগণের ভেতর। আমি মনে। করি নিষ্ঠুর প্রকৃতির আদর্শবাদের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় বাল্য অশান্তির মাধ্যমে। তবে তা প্রশমিত হতে পারে আবেগপ্রবণ প্রাথমিক শিক্ষার দ্বারা। অতি-উৎসাহ আংশিক আবেগ এবং আংশিক বুদ্ধির সমন্বয়ে গঠিত একটি ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতা। একে প্রতিহত করতে হবে মানুষের সদাশয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ার সহায়ক সুখ ও বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রয়োজনীয় বৃদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে।
বাস্তব জীবনে গণতান্ত্রিক সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় মনোভাব বুদ্ধিবৃত্তির জীবনে বিজ্ঞানসম্মত মনোভাবেরই অনুরূপ। এটি ধর্মীয় মতবাদ ও সংশয়বাদের মধ্যবর্তী আশ্রয়স্থল স্বরূপ। এর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বলা যায় যে, সত্য যেমন পুরোপুরিভাবে অর্জন করা যায় না, তেমনি তা অনার্জিতও নয়; শুধু তা অর্জন করা সম্ভব কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত।
স্বৈরাচারের আধুনিকরূপ সবসময় সম্পর্কযুক্ত ধর্মের সঙ্গে। এক্ষেত্রে দেয়া যায় হিটলার, মুসোলিনি ও স্ট্যালিনের স্বৈরাচারীর উদাহরণ। যে সমাজে স্বৈরাচার রয়েছে সেখানে স্বকীয়তাবোধ সৃষ্টির আগেই যুবকদের মনে এক শ্রেণির বিশ্বাস সঞ্চার করা হয়। এই বিশ্বাসগুলো শিক্ষা দেয়া হয় অবিরত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
এই শিক্ষার প্রভাব এমনই যে, আংশকা করা যায় ছাত্ররা পরবর্তী জীবনে কখনও বেরিয়ে আসতে পারবে না এর ঐন্দ্রজালিক প্রভাব থেকে। এগুলো সঞ্চার করা হয় প্রমাণের মাধ্যমে নয় বরং যুক্তির দ্বারা তোতা পাখির মতো বারংবার পুনরানুষ্ঠানের মাধ্যমে, গণহিস্টরিয়া ও গণসম্মোহনের মাধ্যমে। এমন উপায়ে দুটো ধর্মমত শিক্ষা দেয়ার ফলে দু-দল সৈন্যের সৃষ্টি হয়, যার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, কিন্তু আলোচনা করতে পারে না। সম্মোহিত প্রত্যেকটি ব্যক্তিই মনে করে যে, তার পক্ষের বিজয়ই পবিত্রতম অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং আতঙ্কজনক সব কিছুই অপর পক্ষের সৃষ্টি। সংসদে বসে এইসব বিরোধী উন্মাদরা চলতে পারে না চলো দেখি অধিকাংশের মতামত কোন পক্ষে। প্রত্যেক দলই বলে মনে করে পবিত্র উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছে। তাই তারা মাত্রাধিক নীরস। একনায়কত্ব এড়াতে হলে এই ধরনের ধর্মীয় মতবাদ অবশ্যই রদ করা প্রয়োজন এবং শিক্ষার অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিত রদকরণ প্রক্রিয়া।