আগেকার সব স্বৈরাচারী ক্ষমতায় অশুভ বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে বিস্ময়করভাবে দায়িত্বহীন ক্ষমতার মুক্তি আশা করা শুধু বালসুলভ শিশুমালা মনোবিজ্ঞান : ভালো প্রিন্স কর্তৃক দুষ্ট প্রিন্স বিতাড়িত এবং সবই ভালো। কোনো একজন প্রিন্স বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কারণ এই নয় যে তিনি ভালো এবং এজন্যে যে খারাপ হওয়া তার স্বার্থের প্রতিকূলে। এর নিশ্চয়তা বিধান করতে হলে অনুপকারী করে তুলতে হবে ক্ষমতাকে। কিন্তু অনুপকারী করা যায় না একজন ভালো মানুষকে দায়িত্বহীন উৎপীড়কে পরিণত করে।
ডববিসি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে বুঝে নেয়া যেতে পারে সরকারের একচেটিয়া অধিকারের সঙ্গে প্রচারণায় স্বাধীনতা মিলনের সম্ভাব্যতা। এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, তা নিরপেক্ষ থাকতে পারে না সাধারণ ধর্মঘটের সময়; কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় তা গুরুত্বসহকারে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক দেশে প্রয়োজন সভা-সমিতির জন্য হল ভাড়া এবং বিতর্কিত সাহিত্য ছাপার জন্য অনুরূপ নিরপেক্ষ ব্যবস্থার। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যঞ্জনায় বিভিন্ন পত্রিকার পরিবর্তে একটি পত্রিকাই কাম্য। পত্রিকার ভিন্ন ভিন্ন। পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকবে ভিন্ন ভিন্ন দলের জন্য। এর সুবিধা এই যে, সব মতামতই দেখতে পাবে পাঠকরা। বর্তমানে যেসব পাঠক পত্রিকায় নিজেদের মতামতের বিরুদ্ধে কিছুই দেখতে পায় না তাদের চেয়ে কম পক্ষপাত দুষ্ট হবে ওই পত্রিকার পাঠকরা।
সমতা জরুরি নয় শিল্প, বিজ্ঞান এবং দলীয় রাজনীতির মতো বিষয়গুলোতে। এগুলো বৈধ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। এসব বিষয়ের উপর মতপার্থক্য মেনে নেয়া জরুরি। সহনশীল মনোভাব সৃষ্টি করা প্রয়োজন গণতন্ত্রের সফলতা এবং স্থায়িত্বের জন্য; এটি আমাদের নিয়ে আসবে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের কাছাকাছি। বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মনোগত শর্তগুলো কঠিন। আমরা ক্ষমতার মনোগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখেছি ভয়, রোষ এবং উত্তেজনা মানুষকে বাধ্য করে নেতার অনুসরণে। অনেক ক্ষেত্রেই যিনি তাদের আস্থার সুযোগ নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন উৎপীড়ক হিসেবে। সুতরাং গণতন্ত্রের সংরক্ষণ করতে হলে এড়াতে হবে সমবেত উত্তেজনার জন্ম দেয় এমন পরিস্থিতি এবং জনগণের মনে এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যেন অনুরূপ মনোভাব গড়ে না ওঠে। যে সমাজে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ মতবাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সেখানে জনগণের পছন্দ নয় এমন মতামত শান্তি ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলছাত্ররা খারাপ আচরণ করে বেমানান মতামত পোষণকারী কোনো ছেলের প্রতি। স্কুলছাত্রের মানসিক বয়সসীমা অতিক্রম করতে পারেননি অনেক বয়স্ক মানুষ। সংশয়বাদের রঙে রঞ্জিত বিকীর্ণ উদারনৈতিক মনোভাব সামাজিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে অসুবিধা অনেকটা কমিয়ে দেয় এবং অনুরূপভাবে বৃদ্ধি করে স্বাধীনতার সম্ভাবনা।
অনেকের মনে পুনঃভ্যুদ্বয়জনিত উৎসাহ দ্বারা সঞ্চারিত শক্তি ও আপাত আত্মোৎসর্গের ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। ইতিহাসে এমন যৌথ উত্তেজনা অসাধারণ নয় যে এর ফলে ব্যথা ও মৃত্যুর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে উত্তেজিত মানুষ। এর অস্তিত্বের জন্য স্বাধীনতা অসম্ভব। শুধু শক্তিবলে প্রতিহত করা যায় উৎসাহী ব্যক্তিদের। কিন্তু যদি তাদের প্রতিহত করা না যায় তবে তারা অন্যদের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করবে। আমার মনে পড়ে ১৯২০ সালে আমি পিকিংয়ে এক বলশেভিকের সাক্ষাৎ পাই যে কক্ষের ভেতর অগ্র-পশ্চাৎ হাঁটছিল এবং বলছিল, If we do not kill zem, Zey will kill us.ঃ অবশ্য এই মনোভাব এক পক্ষে জন্ম নিলে অন্য পক্ষের মনেও জন্ম হয় একই রকম মনোভাবের। পরিণামে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের সূচনা হয়, যেখানে সব কিছুই বিজয়ের অধীন। যুদ্ধকালীন সামরিক কারণে সরকার স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা অর্জন করে। বিজয় অর্জিতহলে সরকার তার ক্ষমতা প্রথমে শত্রুর অবিশিষ্টাংশ ধ্বংস করার কাজে এবং পরে তার সমর্থকদের উপর ক্ষমতা স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। উৎসাহী মানুষ যে কারণে যুদ্ধ করেছিল ফলাফল ছিল তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অতিউৎসাহের ফলে কিছু কিছু অর্জিত হলেও আশানুরূপ ফল লাভ করা যায় না। বুদ্ধিজাত নয় যৌথ উৎসাহের প্রশংসা, তা বহন করে দায়িত্বহীনতার পরিচয়। কারণ বর্বরতা, যুদ্ধ, মৃত্যু ও দাসত্ব এর ফলাফল।
যুদ্ধ হচ্ছে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ। দায়িত্বহীন ক্ষমতা এড়িয়ে চলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা যুদ্ধ। তাই আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য যুদ্ধ প্রতিহত করা। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবী থেকে যুদ্ধভীতি দূর করতে পারলে সময়মত শাসকদের হিংস্রতা প্রতিহত করার পথ বেরিয়ে আসত। কিন্তু সব যুদ্ধই বিশেষত আধুনিক যুদ্ধ ভীরু ব্যক্তিদেরকে নেতার অন্বেষণে বাধ্য করে এবং সাহসী ব্যক্তিদের সম্মুখবর্তী করে দেয়। এভাবে সুগম হয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথ।
যুদ্ধভীতি জন্ম দেয় বিশেষ ধরনের গণমনোবিজ্ঞানের। আবার এই গণমনোবিজ্ঞান যুদ্ধের ঝুঁকি ও স্বৈরাচারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। সুতরাং আমাদের এমন শিক্ষার প্রয়োজন যার ফলে গণহিস্টরিয়ার দিকে সমাজের ঝুঁকি নিম্নতম পর্যায়ে চলে আসে এবং সম্ভব হয় গণতন্ত্রের সফল অনুশীলন।