ইতিহাস ও মানব প্রকৃতির উপর পড়াশোনা করেছেন এমন ব্যক্তি স্পষ্টই জানেন যে, গণতন্ত্রে পূর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা না থাকলেও তা সমাধানের অপরিহার্য অংশ। রাজনৈতিক শর্তাধীনে থেকে পূর্ণ সমাধান পাওয়া যাবে না। আমাদের অবশ্যই শিক্ষা ও পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত অর্থনীতি, প্রচারণা ও মনোবিজ্ঞানের প্রভাব বিবেচনা করতে হবে। আমাদের বিষয়টি তাই চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে: (১) রাজনৈতিক অবস্থা, (২) অর্থনৈতিক অবস্থা, (৩) প্রচারণা এবং (৪) মনোবিজ্ঞান ও শিক্ষাগত অবস্থা। এগুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা যাক।
(১) নেতিবাচক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। ভালো সরকারের নিশ্চয়তা বিধান করে না তা, তবে নিয়ন্ত্রণ করে কিছু অশুভ দিক। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের আগে বিবাহিত মহিলাদের আপন সম্পত্তি, এমনকি তাদের উপার্জনের উপরও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। দিনমজুর মহিলার মদ্যপ স্বামী তার মজুরির অর্থ ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করার ব্যাপারে বাধা প্রদান করলেও এর প্রতিকারের উপায় ছিল না। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অলিগার্ক সংসদীয় আইন প্রবর্তন করে গ্রামীণ ও শহুরে শ্রমিকদের অবস্থা অবনতি ঘটায় এবং ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি করে। শুধু গণতন্ত্রই ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধকরণ আইন প্রতিহত করেছে। গণতন্ত্রের অস্তিত্ব না থাকলে আমেরিকার পশ্চিমাংশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে শ্বেতকায় অভিজাত শাসিত প্রায়-দাসত্বের মনোভাব সম্পন্ন পীতবর্ণের মানুষের সমন্বয়ে বসতি গড়ে উঠত। দাসত্বের অশুভ দিক পরিচিত এবং যেখানেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করেছে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ আজ হোক কাল হোক দাসত্বের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবেই। ইতিহাসে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে সংখ্যালঘুকে বিশ্বাস করা যায় না সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষায়।
এখনও আগের মতো একটা জোরালো ধারণা বিদ্যমান আছে যে ভালো মানুষের সমন্বয়ে গঠিত অলিগার্ক পদ্ধতি প্রশংসনীয়। কনস্টান্টাইন পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য খারাপ ছিল, পরে তা ভালো হয়ে যায়। রাজাদের বইয়ে এ রকম মানুষ রয়েছেন যারা প্রভুর দৃষ্টিতে ভালো কাজ করতেন। ইংরেজদের ইতিহাসে শিশুদের দেয়া শিক্ষা অনুসারে ভালো রাজা ও খারাপ রাজা রয়েছেন। ইহুদিদের সমন্বয়ে গঠিত অলিগার্ক পদ্ধতি খারাপ কিন্তু নাজিদের অলিগার্ক পদ্ধতি ভালো। আর কমিউনিস্টদের অলিগার্ক পদ্ধতি ভালো কিন্তু অভিজাতদের অলিগার্ক পদ্ধতি খারাপ।
এ ধরনের ধারণা অর্থহীন বয়স্ক মানুষদের সম্পর্কে। আদেশ পালনকারী শিশু ভালো এবং অমান্যকারী খারাপ। যখন সে বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হয় তখনও তার শিশুশালার ধারণা থেকে যায় এবং মনে করে যে আদেশ পালনকারীরাই ভালো এবং অমান্যকারীরা খারাপ। ফলস্বরূপ আমাদের পার্টি কর্মীরা ভালো এবং বিরোধী দলের কর্মীরা খারাপ। আমাদের দলেল সমন্বয়ে গঠিত সরকারই ভালো সরকার এবং অন্য দলের গঠিত সরকার খারাপ। মন্টেগুরা ভালো, কিন্তু ক্যাপুলেটরা খারাপ।
এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বসহকারে পোষণ করলে সামাজিক জীবন অসম্ভব হয়ে পড়ে। শুধু শক্তির মাপকাঠিতে বিভিন্ন দলের ভালো-মন্দ বিবেচনায় স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তা যে কোনো মুহূর্তে উল্টে যেতে পারে। বিদ্রোহের ভয় না থাকলে কোনো দলই ক্ষমতা অর্জনের পর অন্য দলের স্বার্থের প্রতি যত্নশীল হতো না। নিষ্ঠুরতার চেয়ে ভালো কিছু অর্জন করতে হলে সমাজ জীবনে বিশেষ নিরপেক্ষতা প্রয়োজন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সমন্বিত কার্যকলাপ প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাই এসব ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হচ্ছে নিরপেক্ষতার বাস্তব রূপ।
যা হোক প্রয়োজন হলেও গণতন্ত্র কোনো অবস্থায়ই তা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র রাজনৈতিক শর্ত নয়। গণতন্ত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের নৃশংসা ও সম্পূর্ণত অপ্রয়োজনীয় নিষ্ঠুরতা অনুশীলন করা সম্ভব। ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য সরকার (মহিলাদের অন্তর্ভুক্তি ছাড়াই) গণতান্ত্রিক ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আয়ারল্যান্ডের উপর অত্যাচার ব্যাহত করতে পারেনি। শুধু জাতিগত নয়, বরং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণ নির্যাতিত হতে পারেন। সুশৃঙ্খল সরকারের সঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠের নিরাপত্তা বিধান সঙ্গতিপূর্ণ হলে তা পরিণত হয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের অংশবিশেষ।
একতাবদ্ধ যেসব বিষয়ের জন্য হয়ে কাজ করতে হয় এবং যেসব বিষয়ের জন্য জরুরি নয় সমতা, ওইগুলোর আলোচনা প্রয়োজন। যেসব স্পষ্ট বিষয় সম্বন্ধে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয় ওইগুলো মূলত ভৌগোলিক। জনপথ, রেলপথ, ড্রেন, গ্যাস ইত্যাদি আবশ্যিকভাবে একই পন্থা অবলম্বন করে। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কতা (প্লেগ অথবা রাবির বিরুদ্ধে) ভৌগোলিক। এটা খ্রিস্টান বিজ্ঞানীদের জন্য প্রচারের উপযোগী নয় যে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। কারণ অন্যদেরও এগুলো সংক্রমিত করতে পারে। গৃহযুদ্ধ ছাড়া যুদ্ধ একটি ভৌগোলিক ব্যাপার। তারপরও শিগগিরই এই অঞ্চল এক পক্ষ দ্বারা এবং অন্য অঞ্চল অন্য পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।