আকাক্ষার কিছু উদ্দেশ্য এমনই যে যুক্তিযুক্তভাবে সবাই তা উপভোগ করতে পারে। কিন্তু অন্যগুলো প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী সমাজের এক অংশের ভেতর আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যৌক্তিক সহযোগিতার মাধ্যমে সবাই মোটামুটিভাবে ভালো থাকতে পারেন, কিন্তু প্রতিবেশি মানুষের চেয়ে ধনী হওয়ার আনন্দ উপভোগ সবার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু মাত্রায় স্বাধিকার সবাই ভোগ করতে পারে, কিন্তু সবার পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হওয়া অসম্ভব। হয়তো কালক্রমে জনগণ এমন হবে যে, সবাই মোটামুটিভাবে বুদ্ধি সম্পন্ন হবে কিন্তু সবার পক্ষে ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিবৃত্তির জন্য পুরস্কৃত হওয়া অসম্ভব।
বাস্তব মঙ্গল, স্বাস্থ্য, বুদ্ধিবৃত্তি ও বিশ্বজনীন হতে সমর্থ্য ভালো জিনিসের জন্য সামাজিক সহযোগিতা সম্ভব। কিন্তু প্রতিযোগিতায় বিজয়ের আনন্দ বিশ্বজনীন হতে পারে না। পূর্বোক্ত সুখ বন্ধুত্বপূর্ণ ও শেষোক্তটি বন্ধুত্বহীন অনুভূতির মাধ্যমে উন্নীত হতে পারে। বন্ধুত্বহীন অনুভূতির ফলে সুখের যৌক্তির অন্বেষণ সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হয়; বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা কার্যকর। কোনো জনগোষ্ঠীর ভেতর বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভূতি তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেলে বিভিন্ন ব্যক্তি বা দলের মধ্যকার স্বার্থগত কোনো সংঘাত দেখা দেবে না। আধুনিক সমাজে বিদ্যমান সংঘাতের কারণ বন্ধুত্বহীন অনুভূতি, যা পালাক্রমে তীব্র হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। অবশেষে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দুর্ঘটনার ফলে একই রাজার অধীন হলে যুদ্ধের অবসান ঘটে। পরিণামে সবাই সুখি হয়; এমনকি ড, জনসনের Zest তাকে এত আনন্দ দেয় যে, তা ছিল যুদ্ধে বিজয়ের আনন্দের চেয়েও বেশি।
নীতি-বিজ্ঞানের ক্ষমতা বিষয়ের উপর আমরা কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি।
ক্ষমতাসীনদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত সামাজিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা একটি দলের সঙ্গে অন্য দলের নয়, বরং মানবজাতির ভেতর সহযোগিতা। বর্তমানে এই লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে বন্ধুত্বহীন অনুভূতি এবং শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা। প্রত্যক্ষভাবে ধর্ম অথবা নৈতিকতার মাধ্যমে এই অনুভূতি হ্রাস করা যেতে পারে। পরোক্ষভাবে ক্ষমতার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সম্পদের জন্য বিশাল জাতীয় শিল্পের মধ্যকার সংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতা দূর করে তা হ্রাস করা যেতে পারে। উভয় পদ্ধতিই প্রয়োজনীয়। এগুলো পরস্পরের বিকল্প নয়, বরং পরিপূরক।
অনেকেই মহাযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর মিলিটারি এবং সরকারের ক্ষমতা ছাড়া অন্য সব ক্ষমতার কম গুরুত্ব দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। তা হচ্ছে অদুরদর্শী ও অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। সবচেয়ে ক্ষমতাবান চার ব্যক্তির মনোনয়নের ভার আমার উপর অর্পিত হলে আমি বুদ্ধ, খ্রিস্ট, পিথঅগোরাস ও গ্যালিলিওর নাম উল্লেখ করতাম। তাদের কেউ প্রচারণায় সাফল্যলাভের আগে রাষ্ট্রীয় সমর্থন পাননি। জীবিত থাকাকালে কেউই উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেননি। ক্ষমতা প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও তারা মানবজীবনকে যেভাবে প্রভাবিত করতে পারতেন, কেউই তেমন করেননি। অন্য কাউকে দাস বানানোর উদ্দেশ্যে তারা ক্ষমতা অন্বেষণ করেননি, বরং দাসমুক্তির জন্য তা করেছেন। প্রথম দুজন বিবাদ বিসম্বাদে সক্ষম ইচ্ছাশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং দাসত্ব মোচনে সক্ষম হয়েছেন। অপর দুজন প্রাকৃতিক শক্তির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে অর্জন করেন ঈপ্সিত লক্ষ্য। পরিশেষে বলা যায় যে, সহিংসতার মাধ্যমে মানুষ শাসিত হচ্ছে না, বরং মানুষ শাসিত হচ্ছে সুখ-শান্তির জন্য মানুষের সহানুভূতি সৃষ্টিতে সক্ষম ব্যক্তিদের জ্ঞানের দ্বারাই।
১৮. ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ
কনফিউসিয়াস থাই পর্বতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কবরের পাশে দেখতে পেলেন ক্রন্দনরত এক মহিলাকে। তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করার জন্য জুলুকে পাঠালেন। জুলু বললেন, আপনার কান্না দুঃখের পর দুঃখ ভোগকারী মানুষের মতো। মহিলা উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, তা-ই। আমার শ্বশুর একবার এখানে বাঘের শিকারে পতিত হন। আমার স্বামীর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছিল। এখানে একই পথে মারা গিয়েছে আমার ছেলে। প্রভু বললেন, তুমি এই জায়গা ত্যাগ করছ না কেন? উত্তরটি ছিল, এখানে কোনো অত্যাচারী সরকারের অস্তিত্ব নেই। প্রভু তখন বললেন, ওহে আমার সন্তানেরা-স্মরণ করো, বাঘের চেয়েও ভয়ানক অত্যাচারী সরকার।
সরকার বাঘের চেয়ে কম ভয়ানক হবে-এ ধরনের নিরাপত্তা বিধানই হচ্ছে এই পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তু।
ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা উপরোক্ত উদ্ধৃতি অনুসারে প্রাচীন। টাওবাদীরা মনে করতেন এটা সমাধানযোগ্য নয়, তাই তারা ওকালতি করতেন নৈরাজ্যের পক্ষে। কনফিউসিওরা কিছু নৈতিকতা ও সরকারি প্রশিক্ষণের বিশ্বাস করতেন, যা ক্ষমতাসীনদের ভেতর পরিবর্তন এনে তাদের বিচক্ষণতা দান করে এবং আত্মসংযম ও পরোপকারী গুণে গুণান্বিত করে দেয়। একই সময় গ্রিসে গণতন্ত্রী, অলিগার্ক ও অত্যাচারী শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রতিযোগিতা করে; ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে গণতন্ত্র লক্ষ্য স্থির করে, কিন্তু তা কিছু নেতার অস্থায়ী জনপ্রিয়তায় পতিত হয়ে বারবার পরাজিত হচ্ছিল। কনফিউসিয়াসের মতো প্লেটো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জ্ঞানী মানুষদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের ভেতর সমাধান খুঁজেছিলেন। মি. ও মিসেস সিডনে ওয়েভস এই দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্জাগরিত করেন এবং অলিগার্ক পদ্ধতির প্রশংসা করেন। এই পদ্ধতি অনুসারে ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকে নেতৃত্বের গুণাগুণসমৃদ্ধ ব্যক্তিত্বের মধ্যে। প্লেটো ও ওয়েভসের মধ্যবর্তী সময়ে পৃথিবীতে সামরিক স্বেচ্ছাচার, ধর্মতত্ত্ব, বংশগত, রাজতন্ত্র, অলিগার্ক পদ্ধতি, গণতন্ত্র ও দিব্যতন্ত্রের পরীক্ষা হয়ে গেছে। ক্রমওয়েরেলর ইঙ্গিত করেছে সর্বশেষ পদ্ধতিটি যে, এখনও আমাদের সমস্যার সমাধান হয়নি।