হিতকর ক্ষমতাপ্রীতি অবশ্যই ক্ষমতা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবে। আমি বলছি না যে ক্ষমতাপ্রীতি এর নিজের জন্য অবশ্যই হবে না, কারণ সক্রিয় বৃত্তির কোনো এক পর্যায়ে তা নিশ্চিতভাবেই আবির্ভূত হবে। আমি বলছি যে অন্য উদ্দেশ্যের সহায়ক না হলে তা অপূর্ণ থেকে যায়।
এটাই যথেষ্ট নয় যে, ক্ষমতা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য থাকা উচিত; উদ্দেশ্য এমন হবে যে তা অর্জিত হলে লোকের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সাহায্য করবে। যদি আপনি আবিষ্কার অথবা শৈল্পিক সৃষ্টি অথবা সাশ্রয়ী মেশিন আবিষ্কার অথবা এ পর্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন বিভিন্ন দলগুলোর ভেতর আপস মীমাংসার লক্ষ্য স্থির করেন তবে আপনি সফল হলে তা আপনার পাশাপাশি অন্য লোকের আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপায় হয়ে দাঁড়াবে। দ্বিতীয় শর্তটি এই যে, উপকারী বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য ক্ষমতাপ্রীতি অবশ্যই পূর্ণতা অর্জন করবে; সাধারণভাবে বলতে গেলে উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হলে প্রভাবিত ব্যক্তিদের আকাক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিছু উদ্দেশ্যের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কযুক্ত হবে।
তৃতীয় শর্তটির স্পষ্ট রূপদান অপেক্ষাকৃত কঠিন। আপনার উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় অবশ্যই এমন হবে না যে, ঘটনাক্রমে এর খারাপ প্রভাবগুলো অর্জিততব্য উদ্দেশ্যের শ্রেষ্ঠত্বকে অতিক্রম করে যায়। কর্ম ও ভোগের ফলস্বরূপ প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য এবং আকাক্ষা অবিরাম পরিবর্তনশীল। যারা এগুলো করে এবং যারা এগুলোর শিকার তাদের উভয়ের ক্ষেত্রে সহিংসতা ও অন্যায়ের জন্ম দেয়। পরাজয় পূর্ণ না হলে তা ক্রোধ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। অপরপক্ষে তা পূর্ণ হলে অনীহা ও নিষ্ক্রিয়তার জন্ম দেয়। যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যের প্রতি যতই ঔৎসুক্য থাকুক না কেন শক্তি বলে বিজয়লাভের ফলে নিষ্ঠুরতা ও পরাজিতদের প্রতি ঘৃণার জন্ম হয়। এসব আলোচনা থেকে যদিও এটা প্রমাণিত নয় যে, কোনো ভালো উদ্দেশ্যই শক্তি বলে অর্জন করা যায় না, তথাপি আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে শক্তি খুবই বিপজ্জনক এবং এর অতিশয় আধিক্যের ফলে দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তির আগেই যে কোনো ভালো উদ্দেশ্য দৃষ্টির অগোচর হয়ে যেতে পারে।
যা হোক, শক্তি ছাড়া সভ্য সমাজের অস্তিত্ব অসম্ভব। কারণ, সমাজে অসৎ ও সমাজবিরোধী স্বার্থান্বেষী মানুষ রয়েছে যারা নিয়ন্ত্রিত না হলে শিগগিরই অরাজকতায় ও বর্বরতায় প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করে তুলবে। যেখানে শক্তি এড়ানো যাবে না সেখানে অপরাধ আইন অনুসারে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের দ্বারা আরোপিত হবে। যা হোক, এ ক্ষেত্রে দুটো অসুবিধা রয়েছে: প্রথমটি হচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রে শক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারের মধ্যে। কারণ এ ক্ষেত্রে কোনো সাধারণ সরকার নেই, স্বীকৃত কোনো কার্যকরি আইন বা বিচার বিভাগীয় কর্তৃত্ব নেই; দ্বিতীয়টি এই যে, সরকারের হাতে শক্তি কেন্দ্রীভূত হলে সরকার সমাজের বাকি অংশের উপর স্বেচ্ছাচার চালানোর সামর্থ্যলাভ করবে। আমি পরবর্তী পরিচ্ছেদে এই অসুবিধাগুলো আলোচনা করব। এই পরিচ্ছেদে আমি ব্যক্তিগত নৈতিকতা সাপেক্ষে ক্ষমতার আলোচনা করব-সরকারের সাপেক্ষে নয়।
অভিলাসের মতো ক্ষমতাপ্রীতি এমন একটি শক্তিশালী প্রেরণা যে অধিকাংশ মানুষের কার্যকলাপের উপর এর প্রভাব তাদের অনুমিত প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং যুক্তি প্রদর্শন করা যেতে পারে যে, সবচেয়ে বেশি সুফল প্রদানকারী নীতিই ক্ষমতাপ্রীতির প্রতি যুক্তি-পরামর্শের চেয়ে বেশি শত্রুভাবাপন্ন। কারণ ক্ষমতান্বেষণের ক্ষেত্রে নিচের নীতিবিরুদ্ধ পাপের প্রতি মানুষের প্রবণতা রয়েছে। তবে বিধিগুলো কঠোর হলে তাদের কার্যকলাপ সঠিক হতে পারে। নীতিশাস্ত্রীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠাকারী খুব কমই এ ধরনের বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হবেন। কারণ প্রভাবিত হলে তিনি সদগুণের স্বার্থে সচেতনভাবে মিথ্যা ভাষণে বাধ্য হবেন। সত্যনিষ্ঠ হওয়ার চেয়ে নৈতিক উন্নয়নের আকাক্ষা প্রচারক ও শিক্ষাবিদের জন্য মৃত্যুবিশেষ এবং তত্ত্বগতভাবে এর বিরুদ্ধে যাই বলা হোক না কেন বাস্তবে তা ক্ষতিকর। আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ক্ষমতাপ্রীতির জন্যেই মানুষ খারাপ কাজ করছে এবং করে যাবে। তথাপি বলা উচিত নয় যে, ক্ষমতাপ্রীতি অনাকাক্ষিত ওইসব ক্ষেত্রেও যেখানে রয়েছে এর কল্যাণধর্মী প্রয়োগ।
বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতাপ্রীতি মানুষের মেজাজ, সুযোগ-সুবিধা ও তার দক্ষতার উপর নির্ভরশীল; অধিকন্তু মেজাজ পরিবেশ দ্বারা গঠিত হয়। ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতাপ্রীতি বিশেষ খাতে চালনা করতে হলে তার জন্য সঠিক পরিবেশ, সঠিক সুযোগ-সুবিধা ও যথাযথ দক্ষতার ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে চিকিৎসা সাপেক্ষে সুপ্রজননের অন্তর্ভুক্ত জন্মগত স্বভাব প্রশ্নাতীত হয়ে পড়ে। কিন্তু শুধু অল্প সংখ্যক লোকের উপরোক্ত উপায় অবলম্বনে প্রয়োজনীয় কার্যকলাপ বেছে নেয়া যাবে না।
এবার আলোচনা করা যাক মেজাজ প্রভাবিত করার পরিবেশ নিয়ে : নিষ্ঠুর তাড়নাগুলোর উৎস অভাগা শিশুকালে অথবা গৃহযুদ্ধের মতো অভিজ্ঞতার ভেতর দৃষ্ট হয়, যেখানে যন্ত্রণা এবং মৃত্যু প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। কৈশোরে এবং যৌবনের প্রাথমিক অবস্থায় শক্তির বৈধ নির্গমনের অভাবে একই জাতীয় প্রভাব থাকতে পারে। আমি বিশ্বাস করি যে পান্ডিত্যপূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষা পেলে, সহিংসতাপূর্ণ পরিবেশে বসবাস না করলে এবং জীবন গঠনে অযৌক্তিক অসুবিধার সম্মুখীন না হলে অল্প মানুষই নিষ্ঠুর হতো। এসব শর্ত সাপেক্ষে অধিকাংশ লোকের ক্ষমতাপ্রীতি হিতকর অথবা নিদেনপক্ষে নির্দোষ নির্গমনের পথ বেছে নেয়।