পরবর্তী পর্যায়ে ধরা যাক নিয়েজেকের বীরের আচরণ। প্রশংসাকারী পাঠককে অবশ্যই বোঝানো হবে যে তিনি নিজে একজন বীর এবং তিনি দুই প্রকৃতির। অসহৎ ও অপরিণামদর্শী ষড়যন্ত্র দ্বারা তাকে পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে। এ থেকে মনে হয় যে নিয়েজেকের দর্শন খুবই চমৎকার। কিন্তু এভাবে পাঠ করা হলে ও প্রশংসা করা হলে কিভাবে স্থির করা যাবে যে তিনিই বীর হবেন? স্পষ্টতই যুদ্ধ দ্বারা। এ দুয়ের কোনো একজন বিজয় অর্জন করলে তিনি শুধু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেই তার বীর উপাধি বজায় রাখতে সমর্থ হবেন। এর জন্য তাকে ক্ষমতাধর বিশাল গোপন পুলিশ বাহিনী গঠন করতে হবে। তিনি হত্যার ভয়ের মধ্যেই বসবাস করবেন। অন্য সবাই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত থাকবেন এবং এভাবে বীরত্বের সংস্কৃতি নিঃশেষ হবে একটি ভীতিপূর্ণ জাতি গঠনের মধ্য দিয়ে।
একটি বিশ্বাসের পরিণতি আনন্দদায়ক হলে তা সত্য হয়-এ ধরনের বাস্তববাদী তত্ত্বের সঙ্গে একই ধরনের বেদনাদায়ক পরিস্থিতি জন্ম নেয়। কার জন্য আনন্দদায়ক? স্ট্যালিনের প্রতি বিশ্বাস তার জন্য আনন্দদায়ক; কিন্তু ট্রটস্কির জন্য বেদনাদায়ক। হিটলারের প্রতি বিশ্বাস নাজিদের জন্য আনন্দদায়ক; কিন্তু ক্যাম্পে যাদের জড়ো করে রাখা হয়েছিল তাদের জন্য বেদনাদায়ক। নগ্ন শক্তিই শুধু এই প্রশ্নের সমাধান দিতে পারে। কে এই আনন্দদায়ক পরিণতি উপভোগ করবেন? এর উত্তরই প্রমাণ করে যে একটি বিশ্বাস সত্য।
ক্ষমতা দর্শন আপনা থেকেই ভুল প্রমাণিত হয় সামাজিক পরিণতির হিসাব নেয়া হলে। আমি ঈশ্বর-এই বিশ্বাসে অন্য কেউ অংশীদার না হলে তা অচল হয়ে পড়ে। অন্য কেউ অংশীদার হলে তা আমাকে বিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। বীরের সংস্কৃতি একটি কাপুরুষ জাতির জন্ম দেয়। বাস্তববাদের বিশ্বাস ব্যাপকতা পেলে নগ্ন ক্ষমতার শাসনের দিকে ধাবিত করে, যা নিরানন্দের। সুতরাং এর নিজস্ব মাপকাঠি থেকেই বলা যায় যে, বাস্তববাদে বিশ্বাস মিথ্যা। সমাজজীবনে সামাজিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ক্ষমতাপ্রীতি ছাড়া প্রয়োজন অন্য কোনো দর্শনের উপর নির্ভর করা।
১৭. ক্ষমতার নীতি
আমরা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অশুভ ব্যাপারগুলো নিয়ে পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে এতই নিমগ্ন ছিলাম যে, একটা তপস্বীরূপ উপসংহার টানা এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভালো জীবনযাপনের জন্য অপরাপর ব্যক্তিদের প্রভাবিত করার সব প্রচেষ্টা পরিহারে উৎসাহ দান করা স্বাভাবিক বলে মনে হয়। লাওসির সময় থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা বাগী ও বিচক্ষণ ছিলেন। অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাসী অনেকেই শান্তিবাদী ও ব্যক্তিগত পবিত্রতায় মূল্যদানকারী ব্যক্তিরা মনে করেছেন যে তা কার্যকারিতা নয়, বরং মানসিক অবস্থা। আমি এই মানুষের সঙ্গে একমত হতে পারি না, যদিও আমি স্বীকার করি যে তাদের কেউ কেউ পরোপকারী ছিলেন। তারা এ ধরনের ছিলেন কারণ, যদিও তারা বিশ্বাস করতেন যে তারা ক্ষমতা পরিহার করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শুধু বিশেষরূপেই তা পরিহার করতে পেরেছিলেন; যদি তারা পুরোপুরিভাবে তা পরিহার করতে পারতেন তবে তাদের মতবাদের ঘোষণা দিতে পারতেন না এবং পরোপকারী হতেন না। তারা দমনমূলক ক্ষমতা পরিহার করেছিলেন বটে, কিন্তু পরিত্যাগ করতে পারেনি যুক্তি-পরামর্শের উপর নির্ভরশীল ক্ষমতা।
ব্যাপক অর্থে ক্ষমতাপ্রীতি হচ্ছে মানুষ অথবা অন্যান্য জাতি নিয়ে গঠিত বহির্বিশ্বে অভিপ্রেত ফলাফল সৃষ্টির সামর্থ্য লাভের আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা মানব প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ এবং একজন কর্মচঞ্চল মানুষের ভেতর তা গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক। তাৎক্ষণিকভাবে চরিতার্থ করা না গেলেও প্রত্যেক আকাঙ্ক্ষাই একে চরিতার্থ করা না গেলেও প্রত্যেক আকাঙ্ক্ষাই একে চরিতার্থ করার সামর্থ্যলাভের জন্য সহায়ক আকাক্ষার জন্ম দেয়। তাই তা এক প্রকার ক্ষমতাপ্রীতি। তা যেমন সবচেয়ে ভালো আকাক্ষার বেলায় সত্য তেমনি সবচেয়ে খারাপ আকাক্ষার বেলায়ও সত্য। যদি আপনি আপনার প্রতিবেশিকে ভালোবাসেন, আপনি তাদের সুখি করার জন্য ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা পোষণ করেন। তাই ক্ষমতাপ্রীতির সার্বিক নিন্দাবাদ প্রকারান্তরে আপনার প্রতিবেশিকে ভালোবাসারই নিন্দাবাদ।
যা হোক, উপায়মূলক ক্ষমতা ও উদ্দেশ্যমূলক ক্ষমতার ভেতর পার্থক্য বিস্তর। উপায়মূলক ক্ষমতার আশাবাদী ব্যক্তি প্রথমত অন্য কিছু আশা করেন এবং পরে এমন বিশ্বাসে উপনীত হন যে তিনি যেন তা অর্জন করতে সমর্থ। উদ্দেশ্যমূলক ক্ষমতার আশাবাদী ব্যক্তি তা অর্জনের সম্ভাব্যতার দ্বারা তার উদ্দেশ্য ঠিক করে নেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজনীতিতে কোনো মানুষ বিশেষ কার্যক্রম বিধিবদ্ধ দেখতে চান এবং এভাবে তিনি সরকারি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন। অপরদিকে শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যে আশাবাদী ব্যক্তি এমন কার্যক্রম হাতে নেন যা তাকে পৌঁছে দেয় ঈপ্সিত লক্ষ্যে।
এই পার্থক্যের ব্যাখ্যা রয়েছে নির্জন স্থানে ক্রিস্টের তৃতীয় পরীক্ষায়। তিনি নেমে এলে এবং পূজা করলে পৃথিবীর সব কটা রাজ্যই অর্পণ করা হবে। অর্থাৎ বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তার কাছে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে; কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে অর্পণ করার জন্য নয়। এই পরীক্ষা এমন যে স্পষ্টভাবে হোক বা অস্পষ্টভাবে হোক প্রায় প্রতিটি মানুষই এর অধীন। সমাজতন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি রক্ষণশীল পত্রিকার কোনো পদ গ্রহণ করতে পারেন–তুলনামূলকভাবে এটিই হচ্ছে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্র অর্জনে তিনি নিরাশ হতে পারেন এবং সাম্যবাদী হয়ে যেতে পারেন। এর কারণ এই নয় যে, তিনি যা চান তা এই পথে অর্জন করা যাবে। তবে তিনি যা চান এর কিছু কিছু এই পথে অর্জন করা সম্ভব। তিনি যা চান বিফলতার সঙ্গে তার সমর্থন, তিনি যা চান না সফলতার সঙ্গে তার সমর্থন অপেক্ষা অধিক তুচ্ছ বলে মনে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত সফলতা ভিন্ন অন্য কিছুর প্রভাব জোরালো ও সুনির্দিষ্ট হলে ওইসব প্রভাব মেটানো না গেলে তার ক্ষমতানুভূতিতে কোনোরূপ আত্মতুষ্টি আসবে না। সফলতার জন্য উদ্দেশ্যের পরিবর্তন তার কাছে স্বধর্ম ত্যাগের মতোই, যা বর্ণিত হতে পারে শয়তানের পূজা হিসেবেই।