কোনো কোনো দার্শনিক তাদের ক্ষমতা-তাড়না অধিবিদ্যাগত সত্তাকে প্রভাবিত করুক এটা চান না। তবে তারা অনুমোদন করেন নীতিবিদ্যার উপর মুক্ত শাসন। তাদের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন নিয়েজেক। নিয়েজেক খ্রিস্টীয় নৈতিকতাকে দাস নৈতিকতার মতোই অগ্রাহ্য করেন এবং এর পরিবর্তে বীর শাসকদের উপযোগী নৈতিকতার যোগান দিয়ে থাকেন। অবশ্য তা নতুন নয়। এর কিছু কিছু হেরাক্লিয়াস ও প্লেটোর ভেতর এবং অনেকগুলোই রেনেসাঁর ভেতর পাওয়া যায়। নিয়েজেকের ভেতর এর সমাধান করা হয়েছে এবং নিউ টেস্টামেন্টের শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তার দৃষ্টিতে সংঘবদ্ধ মানুষের নিজেদের স্বার্থের দিক থেকে কোনো মূল্য নেই; কিন্তু বীরের মহত্ত্ব অর্জনের উপায় হিসেবে এর মূল্য রয়েছে। বীর নিজের উন্নতি বিধানের জন্য তাদের আহত করার অধিকার রাখেন। বাস্তবে অভিজাতরা সর্বদাই তাদের কর্মপন্থা এমনভাবে স্থির করেছে যে এ ধরনের নীতিশাস্ত্র দ্বারা তা প্রমাণিত। কিন্তু খ্রিস্টীয় তত্ত্ব বলছে যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান। গণতন্ত্র খ্রিস্টীয় শিক্ষার কাছে সমর্থন লাভের জন্য এ আবেদন রাখে। কিন্তু অভিজাতদের কাছে নিয়েজেকের নীতিবিদ্যাই শ্রেষ্ঠ। দেব-দেবি থাকলে আমি কিভাবে দেবতা না হয়ে থাকতে পারতাম? সুতরাং কোনো দেবতা নেই বলেছেন নিয়েজেকের জরাথুস্ত্র। ঈশ্বরকে সিংহাসনচ্যুত করা প্রয়োজন যাতে পৃথিবীতে সন্ত্রাসীদের জায়গা করে দেয়া যায়।
ক্ষমতাপ্রীতি মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক অংশবিশেষ। কিন্তু ক্ষমতা দর্শন একটি বিশেষ অর্থে অস্বাভাবিক। বস্তু ও অন্যান্য মানুষের সমন্বয়ে গঠিত বহির্বিশ্বের অস্তিত্ব তথ্যস্বরূপ এবং তা বিশেষ ধরনের অহংকারকে ধ্বংস করে দেয়। ক্ষমতাপ্রীতির দ্বারা গঠিত বিশ্ব সম্পর্কে বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী মানুষ প্রতি জনপদেই দেখতে পাওয়া যায়। কোনো মানুষ ভাবতেন যে তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর, অন্য মানুষ ভাববেন যে তিনি রাজা। আবার অন্য কেউ ভাববেন যে তিনি ঈশ্বর। অনুরূপ বিপথগামিতা যদি শিক্ষিত মানুষের দ্বারা অস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশিত হয় তবে তা দর্শনের অধ্যাপক হওয়ার পথ সুগম করে দেয়। কিন্তু যদি তা আবেগপ্রবণ মানুষের বাগিতায় প্রকাশিত হয় তবে তা দর্শনের অধ্যাপক হওয়ার পথ সুগম করে দেয়। সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত উন্মাদের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়, কারণ তার কার্যকলাপ প্রশ্নবিদ্ধ হলে সে সহিংসপ্রবণ হয়ে পড়ে। সার্টিফিকেটধারী নয় এমন বিভিন্ন ধরনের মানুষ ক্ষমতাবান সেনাদলের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে এবং তাদের ক্ষমতাধীন সব সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সাহিত্য, দর্শন ও রাজনীতি উন্মাদের সফলতা এ যুগের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। উন্মাদের সফলতার ধরন প্রায় পুরোপুরিভাবে তাড়না থেকে ক্ষমতার দিকে ধাবিত হয়।
এই অবস্থা বোঝার জন্য সমাজ জীবনের সঙ্গে ক্ষমতা দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা করা প্রয়োজন। আমাদের ধারণার চেয়েও জটিল হতে পারে এই সম্পর্কটি।
আমরা সলিপজিসম দিয়ে শুরু করতে পারি। যখন ফিকট মনে করেন যে, সব কিছুই অহং থেকে শুরু হয়, তখন পাঠকরা মনে করেন না যে সবকিছু জোহান গটলিয়ের ফিকট থেকে শুরু হয়। কেমন অদ্ভূত? কিছুদিন আগে পর্যন্ত কেন আমি তাকে শুনতে পাইনি? তিনি কি প্রকৃতই মনে করেন যে তিনি তাদের আবিষ্কার করেছেন? কি হাস্যকর অহংবোধ? আমি পুনর্বার বলি যে পাঠক তা বলছেন না। তিনি ফিকটের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন এবং যুক্তিগুলোকে অকাট্য দেখছেন না। তিনি চিন্তা করেন, মোটের উপর অতীত সম্বন্ধে আমি কি জানি? আমার কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে যেগুলো আমি বাছাই করেছিলাম আমার জন্মের আগের সময় সম্বন্ধে ব্যাখ্যাস্বরূপ। যেসব জায়গা আমি দেখিনি এগুলো সম্পর্কে আমি কি বলতে শুনেছি। আমি যদি ঈশ্বরের জায়গায় নিজেকে মনে করি এবং বলি যে বিশ্ব আমারই সৃষ্টি তবে কোনো কিছু দিয়েই প্রমাণ করা যাবে না যে আমি ভুল করছি। ফিকট মনে করছেন যে শুধু ফিকটই আছেন এবং জন স্মিথ যুক্তিগুলো পড়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যে শুধু জন স্মিথই আছেন। কিন্তু জন স্মিথ কখনও খেয়াল করেননি যে ফিকটের কথা তা নয়।
এভাবে সলিপসিজমের বিশেষ ধরন সমাজজীবনের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। কিছু সংখ্যক পাগল, যারা প্রত্যেকেই নিজেকে ঈশ্বর মনে করে, একে-অন্যের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে আচরণের শিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু যে পর্যন্ত প্রতিটি ঈশ্বরই নিজেকে Omnipotence হিসেব দেখতে পায় ততক্ষণই তাদের এই বিনয়ভাব বজায় থাকে। যদি মি. A নিজেকে ঈশ্বর ভাবেন তাহলে তিনি অন্যদের কার্যকলাপ ততক্ষণ মেনে নেবেন যতক্ষণ তাদের কার্যকলাপ তার উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক হবে। কিন্তু যদি মি. B তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেন এবং বুঝতে চান যে তিনি Omnipotence নন তাহলে মি. Aর আবেগ জাগ্রত হবে এবং তিনি বুঝে নেবেন যে মি. B হচ্ছে শয়তান অথবা তার সমর্থক। মি. B ও A সম্পর্কে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন। প্রত্যেকেই দল গঠন করবেন। ফলে যুদ্ধ বাধবে। এটা হবে ধর্মযুদ্ধ, যা হবে তীব্রতর; নিষ্ঠুরতর এবং অধিকতর উন্মাদনাযুক্ত। ধরা যাক মি. A হচ্ছেন হিটলার এবং মি. B হচ্ছেন স্ট্যালিন। তাদের দুজনের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের একটি চিত্র পেতে পারেন। হিটলার বলবেন, আমি মুক্তিদাতা। স্ট্যালিন বলবেন, আমি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। কিন্তু যেহেতু তাদের দাবি বিশাল সেনাবাহিনী, উড়োজাহাজ, বিষাক্ত গ্যাস ও নির্দোষ ব্যক্তিদের সমর্থপুষ্ট তাই উভয়ের উন্মাদনা থেকে যাবে মানুষের অলক্ষ্যেই।