ফিকটের দর্শন শুরু হয় পৃথিবীতে একক অস্তিত্বশীল সত্তার অহংবোধ থেকে। শুধু নিজেকে সত্য বলে মনে নেয় বলেই এই অহংবোধ রয়েছে। যদিও অন্য কিছুই বিরাজ করে না তারপরও এই অহংবোধ একদিন ধাক্কা খায় এবং এর ফলে অহংবোধহীনতা সত্যে পরিণত হয়। তা তখন ধাবিত হয় বিভিন্ন উদ্ভবের দিকে। সংশয়বাদিতা উদ্ভবের কারণ হিসেবে ঈশ্বরের দিকে ইঙ্গিত করে। ফিকট মনে করেন যে, ঈশ্বর ও অহংবোধের ভেতর পার্থক্য অপ্রয়োজনীয়। অহংবোধ ও অধিবিদ্যার ভেতর সমন্বয় হলে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, জার্মানরা ভালো এবং ফরাসিরা খারাপ। তাই নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জার্মানদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। জার্মান ও ফরাসিরা শুধু ফিকটেরই আবিষ্কার। কিন্তু জার্মানরা উন্নততর এবং তারা চূড়ান্ত বাস্তবতার অধিকতর নিকটবর্তী বা ফিকটের অহং। আলেকজান্ডার ও অগাস্টাস নিজেদের দেবতা বলে দাবি করেছেন এবং অন্যদের চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ভান ধরতে বাধ্য করেছেন। ফিকট সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন না। তাই তাকে চাকরি হারাতে হয় নাস্তিকতার দায়ে। কারণ তিনি ঘোষণা দিতে পারেননি কোনো স্বর্গীয় সত্তার।
সামাজিক কর্তব্যের কোনো স্থান নেই ফিকটের অধিবিদ্যায়। কারণ বহির্বিশ্ব শুধু আমারই স্বপ্ন। এই দর্শনের সঙ্গে মানানসই কাল্পনিক নীতিশাস্ত্র হচ্ছে আপন উন্নয়নের। অযৌক্তিকভাবে একজন মানুষ ভাবতে পারেন যে তার পরিবার বা জাতি তার অহংয়ের অংশবিশেষ। তাই তার অধিকতর মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এভাবেই স্বাভাবিক সৃষ্টি জাতি ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস সলিপসিস্টিক দর্শনের। সর্বোপরি যেহেতু ক্ষমতাপ্রীতি তত্ত্বকে অনুপ্রাণিত করে, তাই ক্ষমতা শুধু অর্জন করা যেতে পারে অন্যান্য বিষয়ের সাহায্যে।
এ সবই আদর্শবাদ হিসেবে পরিচিত এবং বহির্বিশ্বের বাস্তবতা স্বীকৃতিদানকারী দর্শনের চেয়ে তা নৈতিক দিক থেকে বিবেচিত মহত্তর বলে।
আমার ইচ্ছা থেকে সত্যের ধারণায় মূর্ত হয়ে ওঠে স্বাধীন বিষয়ের বাস্তবতা। আমার বিশ্বাসের সত্য উপাদানটি এমন কিছুর উপর নির্ভর করে না যা আমি করতে পারি। আমি আগামীকাল আমার প্রাতঃভোজন সম্পন্ন করব-এই বিশ্বাস আংশিকভাবে নির্ভর করে আমার ইচ্ছাশক্তির উপর। কিন্তু মার্চের ১৫ তারিখ সিজারকে হত্যা করা হয়–এ ধরনের বিশ্বাস ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করে না। ক্ষমতাপ্রীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত দর্শনে এ ধরনের অবস্থা নিরানন্দের এবং তাই তা সত্য ও মিথ্যার উৎস হিসেবে সত্য ঘটনার সাধারণ ধারণাকে ধ্বংস করতে শুরু করে। হেগেলের অনুসারীরা বলেন যে, সত্য ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হলেই সত্য বিরাজ করে না। বরং আমাদের বিশ্বাসের পুরো পদ্ধতির পারস্পরিক সমন্বয়ের উপর তা নির্ভর করে। আপনার সব বিশ্বাসই সত্য হবে যদি এগুলোর সবই মানানসই হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনো পার্থক্য নেই ঔপন্যাসিকের সত্য ও ঐতিহাসিকের সত্যের ভেতর। এভাবে সৃজনশীলতা মুক্তি লাভ করে বাস্তব বিশ্বের শিকল থেকে।
বাস্তববাদ হচ্ছে এর বিশেষরূপে ক্ষমতা দর্শন। বাস্তবাদ অনুসারে কোনো বিশ্বাসের ফলাফল আনন্দদায়ক হলে তাই সত্য। এখন মানুষই পারে একটি বিশ্বাসের পরিণতিকে আনন্দ বা নিরানন্দের ব্যাপারে পরিণত করতে। একনায়কের সদগুণে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চেয়ে অধিকতর আনন্দদায়ক পরিণতি বয়ে আনে যদি আপনি এর সরকারের অধীনে বসবাস করেন। যেখানেই কার্যকরি নির্যাতন বিরাজমান সেখানে বাস্তবতাবোধে অফিসিয়াল বিশ্বাসই সত্য। তাই বাস্তববাদী দর্শন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদেরকে অধিবিদ্যাগত Omnipotence দান করে, যা একটি অধিকতর পেডিস্ট্রিয়ান দর্শন অগ্রাহ্য করে। আমি বলছি না যে, সবচেয়ে বেশি বাস্তববাদীরা এই পরিণতিগুলোকে তাদের নিজেদের দর্শন বলে গ্রহণ করেন। আমি শুধু বলছি যে, সত্য সম্বন্ধে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির উপর বাস্তববাদীদের আক্রমণ ক্ষমতাপ্রীতি থেকে উদ্ভূত। অবশ্য প্রাণহীন প্রকৃতির উপর এর ক্ষমতা মানুষের উপর ক্ষমতার চেয়ে বেশি।
বার্গসঁর সৃষ্টিশীল বিবর্তন হচ্ছে একটি ক্ষমতা দর্শন যা বার্নার্ডশর Back to Methusaleh নাটকের শেষ দৃশ্যে অতি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। বার্গ বলেছেন যে, বুদ্ধিবৃত্তি নিন্দিত, কারণ তা অবৈধভাবে নিষ্ক্রিয় এবং শুধুই চিন্তার ভেতর সীমাবদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রাণীগুলো চক্ষু অর্জন করেছে কারণ তারা অনুভব করে যে কোনো কিছু দেখতে সমর্থ হওয়া তাদের জন্য আনন্দদায়ক হবে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তি দৃষ্টি সম্পর্কীয় চিন্তাভাবনায় সমর্থ হয়ে ওঠেনি। কারণ তারা ছিল অন্ধ। কিন্তু intuition ই এর অদ্ভুত কাজ সম্পাদনে সমর্থ হয়। তার মতে সর্বপ্রকার বিবর্তনের মূলে রয়েছে আকাঙ্ক্ষা। আকাক্ষা যথেষ্ট আবেগপূর্ণ হলে অর্জন সীমাহীন হয়ে পড়ে। জীবন গঠন (যান্ত্রিক) বোঝার ক্ষেত্রে জীব রসায়নবিদদের প্রচেষ্টা তুচ্ছ বলে মনে হয়, কারণ জীবন গঠন যান্ত্রিক নয়, এর পরিবর্ধন এমনই যে মানুষের পক্ষে বুদ্ধিমত্তার দ্বারা এর সম্বন্ধে অগ্রিম কল্পনা করা অসম্ভব। কাজের দ্বারাই শুধু জীবনকে বোঝা যায়। ফলাফল দাঁড়াচ্ছে যে, মানুষ আবেগপ্রবণ হবে। সৌভাগ্যজনকভাবে বার্গসঁর সুখের জন্য ওইগুলো স্বাভাবিকভাবে তাই।