কাপুরুষদের সংগঠন গড়ে ওঠে শুধু নেতার প্রতি বশ্যতা স্বীকারের মধ্য দিয়েই নয়, বরং তা গড়ে ওঠে সমমনা মানুষের ভেতর নিশ্চিত ঐক্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে। আনন্দানুভূতি বিদ্যমান সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত উদ্যমপূর্ণ জনসভায় উৎসাহ ও নিরাপত্তার সমন্বয়ে। অহংবোধ বৃদ্ধি পেলে বিজয়ানুভূতি ছাড়া অন্য সবই সাধারণ আবেগের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে দূরীভূত হয়। আনন্দদায়ক কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন সমবেত উত্তেজনা। এর ফলে সহজেই স্বাভাবিকতা, মানবতা ও আত্মরক্ষা বিঘ্নিত হয়। অবশ্য সমভাবে সম্ভব সহিংসতা ও শহীদের বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু। এর ছোঁয়া একবার পেলে অন্যান্য উন্মত্ততার মতো তা প্রতিহত করা কঠিন। কিন্তু এটি পরিশেষে অনীহা ও ক্লান্তি এনে দেয় এবং উত্তরোত্তর আগ্রহের জন্ম দেয় প্রথমোক্ত আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
কোনো নেতা অপরিহার্য নয় এই তাড়না সৃষ্টির জন্যে। কারণ তা সৃষ্টি করা যেতে পারে সঙ্গীত এবং উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে বক্তার কথা। সুতরাং নেতৃত্বের জন্য সংঘবদ্ধ আনন্দ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নেতার অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই নিজের জাগানো অনুভূতিতে। তিনি শেক্সপিয়রের এন্তনিয়র মতোই বলতে পারেন :
Now let it work : mischief there art afoot,
Take thou what course thou will!
নেতার প্রভাব না থাকলে অনুসারীদের উপর তার সফলতার সম্ভাবনা কম। এ কারণে তিনি গুরুত্ব দেবেন এমন পরিস্থিতির যা তার সাফল্য সহজ করে দেয়। যে পরিস্থিতির মোকাবেলায় নিজেকে সাহসী মনে করা মারাত্মক বিপদ তা-ই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু ভীতি সৃষ্টির মতো এত ভয়ানক নয়। দুর্দমনীয় হচ্ছে এমন পরিস্থিতি, কিন্তু অজেয় নয়। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধংদেহী মনোভাব জাগাতে একজন দক্ষ বক্তা চান শ্রোতাদের ভেতর দুই স্তরের বিশ্বাস সৃষ্টি করতে। এর একটি হলো অগভীর স্তর, এতে বড় করে দেখানো হয় শত্রু পক্ষের ক্ষমতা এবং ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করা হয় যে এর মোকাবেলায় অধিক সাহস সঞ্চয় করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যটি হলো গভীর স্তর, যেখানে বিরাজ করে বিজয়ের দৃঢ় বিশ্বাস। অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে শক্তির উপর-এ ধরনের স্লোগানে উভয়টি বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
বক্তার প্রত্যাশা হলো চিন্তাশীল জনগণ অপেক্ষা আবেগপ্রবণ আন্দোলনকারীর জনতা। ভয় ও ঘৃণায় পূর্ণ থাকবে তাদের মন। তাদের ধৈর্য থাকবে না ধীর ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যদি বক্তা সম্পূর্ণ নিন্দুক না হন তাহলে তিনি কিছু বিশ্বাস অর্জন করবেন, যা প্রমাণ করবে তার কার্যকলাপের বৈধতা। তিনি যুক্তির চেয়ে অনুভূতিকেই ভালো পথপ্রদর্শক ভাববেন। মতামত গঠনে রক্ত মস্তিষ্ক অপেক্ষা অধিকতর কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত উপাদানই হলো জীবনের সবচেয়ে ভালো উপাদান। তার হাতে শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকলে তিনি শিক্ষাকে অনুশীলন ও যৌথ আন্দোলনের পর্যায়বৃত্ত গতির ভেতর সীমাবদ্ধ রাখবেন এবং একই সঙ্গে তিনি জ্ঞান ও বিচার ক্ষমতা ত্যাগ করে যাবেন অতিমানবিক বিজ্ঞানের নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের কাছে।
ক্ষমতালোভী ব্যক্তিরা সবাই বক্তা নন। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের তারা। ক্ষমতা প্রীতির দাবি মিটানো হয়েছে কার্য সম্পাদনের ব্যবস্থাপনার উপর নিয়ন্ত্রণ দ্বারাই। উদাহরণস্বরূপ বিবরণ দেয়া যায় আবিসিনিয়ার আকাশযুদ্ধে মুসোলিনির কর্তৃত্বের:
জঙ্গলে আগুন দিতে হয়েছিল আমাদের। ছোট ছোট গ্রাম এবং মাঠেও। মাটি ছোঁয়ার আগেই বোমাগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছিল সাদা গ্যাস নির্গত করে এবং এগুলোর লেলিহান শিখা দেখাচ্ছিল। তখন জ্বলতে আরম্ভ করে শুকনো ঘাস। আমি ভাবছিলাম পশুগুলোর কথা : খোদা কিভাবে দৌড়াচ্ছিল ওরা! আমি হাতদিয়ে এগুলো ফেলছিলাম বোমা রাখার তাক শূন্য হওয়ার পর। লম্বা বৃক্ষ বেষ্টিত জারিরাতে আঘাত করা সহজ ছিল না, এটাই ছিল সবচেয়ে মজাদার ব্যাপার। আমাকে খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়েছিল খড়ের চালে। আমি সফল হয়েছিলাম তৃতীয়বারের চেষ্টায়। হতভাগ্যরা ভেতরেই ছিল। ওরা যখন দেখল তাদের ঘরের ছাদ জ্বলে যাচ্ছে তখন তারা লাফিয়ে বের হয়ে দৌড়াতে লাগল পাগলের মতো।
প্রায় পাঁচ হাজার আবিসিনীয় বৃত্তাকার আগুনে আটকা পড়ে অনভিপ্রেত পরিণতির শিকার হলো। এটা নরকসদৃশ।
বক্তা যখন সজ্ঞাত মনস্তত্ত্বের প্রয়োজন বোধ করেন তার সফলতার জন্যে, ব্রুনো মুসোলিনির মতো বিমানচালক আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা বেদনাদায়ক এমন মনস্তত্ত্বেই আনন্দ পান। বক্তা হলেন প্রাচীন ধরনের; সংগঠনের ব্যবস্থার উপর যার ক্ষমতা নির্ভরশীল তিনি আধুনিক। এ উদাহরণ আংশিকভাবে হলেও দেয়া যেতে পারে যে, যুদ্ধ শেষে প্রথম কার্তেজ বিদ্রোহপ্রবণ ভাড়াটে সৈন্যদের হত্যা করার জন্য কিভাবে ব্যবহার করেছিলেন হাতি। এক্ষেত্রে মনস্তত্ত্ব ব্রুনো মুসোলিনির মনস্তত্ত্বের মতোই। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে আমাদের যুগেই যান্ত্রিক ক্ষমতা অন্য যুগের চেয়ে অধিক বৈশিষ্ট্য বহন করে।
এ পর্যন্ত কোথাও পূর্ণতা লাভ করেনি যান্ত্রিক ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল অলিগার্কি মনস্তত্ত্ব। যা হোক এর আসন্ন সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা গুণগত দিক দিয়ে না হলেও পরিমাণগত দিক দিয়ে একেবারে নতুন। কৌশলগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অলিগার্কির পক্ষে সম্ভব প্রজাগণের সমর্থন লাভ না করেই এরোপ্লেন, পাওয়ার স্টেশন, মোটরযান ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। লুপুতা সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো এর কেন্দ্র ও বিদ্রোহাত্মক প্রদেশের ভেতর মধ্যস্ততা করার সামর্থ্য দ্বারা। একই জাতীয় কঠিন কিছু করা ঐক্যবদ্ধ বৈজ্ঞানিক কুশলীদের পক্ষে সম্ভব। তারা অনশনে রাখতে পারত অবাধ্য এলাকার জনগণকে এবং বঞ্চিত রাখতে পারত লাইট, তাপ ও বিদ্যুৎ শক্তির মতো আরামপ্রদ উপকরণে ব্যবহারের নির্ভরতায় উৎসাহদানের পর। তারা ভাসিয়ে দিতে পারত বিষাক্ত গ্যাস ও বেকটেরিয়ার বন্যায়। বিরোধিতা হলো চূড়ান্ত নিরাশাব্যঞ্জক। যন্ত্রের গঠন কৌশলের উপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিরা মানুষকে অনুভূতিহীন এবং কিছু নিয়মকানুনের অধীন বলে গণ্য করে। ব্যবহারকারী এসব নিয়ম-কানুন নিজ সুবিধামত কাজে লাগাতে পারেন। অন্য যে কোনো সময়ের সরকার ব্যবস্থাপনার চেয়ে এমন সরকারের নিষ্ঠুরতা বেশি।