ইতিহাসে পরিচিত বৈপ্লবিক পরিবেশে আবির্ভূত হয়েছেন কোনো কোনো নেতা। আমরা এখন আলোচনা করব ক্রমওয়েল, নেপোলিয়ন এবং লেলিনের ওইসব গুণ সম্পর্কে যা তাদের সফলতা এনে দিয়েছে। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশে আধিপত্য বিস্তার করেন এবং সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের স্বেচ্ছামূলক সেবাকর্ম গ্রহণ করেন, যারা স্বভাবগতভাবে অধীনতামূলক আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন না। অফুরন্ত সাহস ও আত্মবিশ্বাস ছিল তাদের। সংকটমুহূর্তে তাদের সহকর্মীরা এগুলো সহযোগে উত্তম ব্যক্ত করতেন অভিমত। এই তিনজনের ভেতর ক্রমওয়েল ও লেলিন ছিলেন এক ধরনের আর নেপোলিয়ন ছিলেন ভিন্ন ধরনের। প্রগাঢ় ধর্মবিশ্বাস ছিল ক্রমওয়েল এবং লেলিনের। অতিমানবীয় কার্য সম্পাদনের জন্য নিয়োজিত-এমন বিশ্বাস করতেন তারা। তাদের ক্ষমতালাভের তাড়না নিঃসন্দেহে ন্যায়ভিত্তিক বলে তারা মনে করতেন বিলাস ও আরামের মতো পুরস্কার লাভের জন্য তারা খুব কমই যত্নবান ছিলেন। কারণ তা সৃষ্টি সম্পর্কিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে তারা মনে করতেন। তা আবার বিশেষভাবে সত্য লেলিনের বেলায়। জীবনের শেষের দিকে পাপে পতিত হওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন ক্রমওয়েল। তা সত্ত্বেও তারা উভয়ই তাদের অনুসারীদের মাঝে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন বিশ্বাস ও সামর্থ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে নেতৃত্বে বিশ্বাস সৃষ্টির বিষয়ে।
ক্রমওয়েল ও লেলিনের বিপরীতধর্মী ছিলেন নেপোলিয়ন। তিনি সৌভাগ্যবান সৈনিকের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন। তাকে যোগ্য হওয়ার সুযোগ এনে দেয় বিপ্লব। না হলে তিনি উদাসীন হতেন এর প্রতি। যদিও তিনি ফরাসি দেশপ্রেমের বাসনা চরিতার্থ করেন তারপরও ফ্রান্স ছিল তার কাছে বিপ্লবের মতো একটি সুযোগ মাত্র। যৌবনে তিনি কারসিকার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ধারণা পোষণ করেন। তার সফলতার পেছনে অসাধারণ চরিত্রবল ততটা ছিল না যতটা যুদ্ধের কলা-কৌশলগত দক্ষতার ভূমিকা ছিল। তিনি জয়যুক্ত হতেন যখন অন্যরা পরাজিত হতো। তিনি সফলতার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতেন ১৮ মেয়ার এবং সারেঙ্গার চূড়ান্ত সময়ে। তার কো-এডজুটেন্টদের সাফল্যগুলোর সংযোজনে তার দান তাকে সাহায্য করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল ফরাসি সৈন্যদল। তাকে সফলতা এনে দেয় নেপোলিয়নের চাতুর্যই। অবশেষে ভাগ্যতারকায় বিশ্বাস তার পতন ঘটায়। এটি তার বিজয়ের ফল–কারণ নয়।
এ যুগে ক্রমওয়েল ও লেলিনের শ্রেণিভুক্ত হলো হিটলার আর মুসোলিনি নেপোলিয়নের ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিকদের ধারণার চেয়েও বেশি গুরুত্ব রয়েছে সৌভাগ্যবান সৈনিক অথবা দস্যুপ্রধানদের। কখনও তিনি নেপোলিয়নের মতো কোনো জনগোষ্ঠীর নেতা হতে সমর্থ হন যার উদ্দেশ্য আংশিকভাবে নৈর্ব্যক্তিক। ফরাসি বিপ্লবের সৈনিকরা নিজেদের ইউরোপের উদ্ধারকর্তা বলে মনে করত। একইভাবে অনেকে তা-ই ভাবত ইতালি ও পশ্চিম জার্মানিতে। কিন্তু নিজের উন্নতি বিধানের জন্য প্রয়োজনের বেশি স্বাধীনতা অর্জন করেননি নেপোলিয়ন। প্রায়ই নৈর্ব্যক্তিক উদ্দেশ্যের ছলনার অস্তিত্ব থাকে না। প্রাচ্যকে আলেকজান্ডার হয়তো গ্রিসে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার এ ধরনের অভিযানে মেসিডোনীয়রা যে আগ্রহী ছিল যথেষ্ট সন্দেহ আছে তাতে। প্রজাতন্ত্রের শেষ একশো বছর রোমান জেনারেলরা প্রধানত অর্থের সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন এবং তাদের সৈনিকদের আস্থা অর্জন করেন জমি ও সম্পদ বিতরণের মাধ্যমে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতে সিসিল রোডস। বেশ ফলদায়ক হয়েছিল এই বিশ্বাস। মিটারল্যান্ড জয় করার জন্য তিনি যেসব সৈনিককে নিয়োজিত করেছিলেন তাদের নগ্নভাবে দেখানো হয় আর্থিক প্রলোভন। বিশ্বযুদ্ধগুলোতে প্রলোভনের ভূমিকা রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে।
প্রধানত ভীতির মাধ্যমেই সাধারণ শান্তিপ্রিয় নাগরিক নেতার অনুগত হয়। এ কথাটি শান্তিপূর্ণ কোনো পেশার সম্ভাবনা না থাকলে ডাকাতদলের বেলায় প্রযোজ্য নয়। নেতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি বিদ্রোহী লোকের মনে ভয় সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু নেতা না হলে এবং অধিকাংশ মানুষ কর্তৃত্ব স্বীকৃতি না পেলে তিনি ভয় সৃষ্টি করতে পারেন না। নেতৃত্ব অর্জন করতে তার কর্তৃত্বের উপযোগী আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন এবং তাকে গুণান্বিত হতে হবে ত্বরিত ও দক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুণে। নেতৃত্ব আপেক্ষিক : এন্তনিকে সিজার অধীনস্ত করতে পারতেন, কিন্তু তা অন্য কেউ পারত না। অধিকাংশ মানুষ মনে করে রাজনীতি খুব কঠিন এবং কোনো নেতাকে অনুসরণ করাই শ্রেয়। প্রবৃত্তিবশত তারা অবচেতন মনে তা অনুভব করে থাকে, যেভাবে কুকুর আচরণ করে তার প্রভুর প্রতি। তা না হলে খুব কমই সম্ভব হতো সংঘটিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ।
সুতরাং কাপুরুষতার দ্বারা সীমিত হয়ে পড়ে ক্ষমতাপ্রীতি। আবার আত্মনিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছাকেও সীমিত করে কাপুরুষতা। আকাঙ্ক্ষা পূরণে ক্ষমতা অধিকতর সহায়ক বিকল্প পন্থার চেয়ে। সুতরাং ক্ষমতার প্রত্যাশাই স্বাভাবিক যদি কাপুরুষতা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। এ ধরনের কাপুরুষতা দায়িত্ব পালনের অভ্যাসের দ্বারা কমানো যেতে পারে। সুতরাং ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা বাড়াতে দায়িত্ব সক্ষম। একজন মানুষকে নিষ্ঠুরতা ও বন্ধুত্বহীনতা যে কোনো দিকে চালাতে পারে। সহজেই যারা ভীত হয় তা তাদেরকে ইচ্ছা যোগায় দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার। সাহসী ব্যক্তিরা উৎসাহ পায় তাদের অবস্থান খুঁজে বের করার, ফলে দুঃখভোগ। করার চেয়ে তারা নিষ্ঠুরতা চালাতে পারে।