Understanding Human Nature নামক বইয়ে এডলার দুই ধরনের মানুষের পার্থক্য দেখিয়েছেন–একটি শাসিত অন্যটি শাসক। তিনি বলেন, অন্যের দ্বারা আরোপিত নিয়ম শাসিত ব্যক্তি মেনে চলে এবং সব সময় একটা হীন অবস্থা খুঁজে বের করে নিজের জন্যে। অন্যদিকে শাসকশ্রেণি কি করে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ হতে পারে তা ভাবতে থাকে। প্রয়োজনের সময় বিপ্লবের মাধ্যমে সবার উপরে উঠে আসেন এমন মানুষও দেখতে পাওয়া যায়। উভয় ধরনের লোকই তাদের চরম অবস্থায় অনভিপ্রেত বলে এডলার মনে করেন। শিক্ষার ফসল বলে তিনি তাদের অভিহিত করেন। তিনি বলেন, কর্তৃত্বপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুমনে ক্ষমতার একটি আদর্শিক ধারণার জন্ম দেয়, এটা একটা বড় অসুবিধা এবং এটি ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন এক আনন্দের দিকে ইঙ্গিত করে। আমরা আরও বলতে পারি, কর্তৃত্বপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করে দাস ও স্বেচ্ছাচারী মানুষ। কারণ তা তাদের এই অনুভূতির দিকে ধাবিত করে যে দুজন মানুষের মাঝে সহযোগিতার একমাত্র সম্পর্ক হচ্ছে এক ব্যক্তি আদেশ প্রদান করবে এবং অন্য ব্যক্তি তা মেনে চলবে।
সীমিত ক্ষমতা বিশ্বজনীন; কিন্তু বিরল চরম ক্ষমতালিপ্সা। গৃহ পরিচালনায় একজন মহিলা যে ক্ষমতা রাখেন তা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার তুলনায় কম বলেই মনে হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্র শাসন করতে যখন আব্রাহাম লিংকন ভীত নন তখন তিনি মোকাবেলা করতে পারেননি নিজ দেশে গৃহযুদ্ধের। নৌকায় পালানোর জন্য ব্রিটিশ অফিসারদের আদেশ নোপোলিয়ন হয়তো মাথা পেতে নিতেন বেলেরোফন জাহাজ ডুবির মতো দুর্ঘটনায় পতিত হলে। মানুষ যতক্ষণ তার যোগ্যতায় বিশ্বাস করে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সে ক্ষমতার আশা করে। কিন্তু যখন নিজের অযোগ্যতা সম্বন্ধে বুঝতে পারে তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় একজন নেতাকে অনুসরণ করার।
আদেশদানের প্রেরণার মতোই প্রকৃত ও সাধারণ আনুগত্যের প্রেরণা। ভয়ের ভেতর এর জন্ম। চরম অবাধ্য ছেলের দলও অগ্নিকাণ্ডের মতো ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতে পুরোপুরি বাধ্য হয়ে যায় যোগ্য বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির। প্যাস্কারসরা যুদ্ধের সময় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল লয়েড জর্জের সাথে। অধিকাংশ লোকই বিপদ দেখা দিলে নেতা খুঁজে বের করে এবং আত্মসমর্পণ করে তার কাছে। এ রকম সময়ে খুব কম লোকই স্বপ্ন দেখে বিপ্লবের। সরকারের প্রতি জনগণের এ ধরনের মনোভাব পরিলক্ষিত হয় যখন যুদ্ধ বাধে।
সব সময় এমন কথা সত্য নয় যে বিপদ মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে সংগঠনগুলো গঠিত হয়। কয়লা খনির মতো কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিপদাপন্ন হতে পারে সংগঠনগুলো। কিন্তু তা নিতান্তই আপতিত। এগুলো যদি দূর করা যেত তাহলে প্রভূত সমৃদ্ধি হতো সংগঠনগুলোর। সাধারণ বিপদ মোকাবেলা করা অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রধান উদ্দেশ্যের আওতাভুক্ত নয়। অথবা অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ে ব্যস্ত রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোরও নয়। কিন্তু বিপদ মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যেই জীবনতরী ও অগ্নিনির্বাপক বাহিনী তৈরি করা হয়। ধর্মীয় সংগঠনের বেলায়ও একটি বিশেষ লঘু অর্থে সত্য, যেগুলো আমাদের প্রকৃতির গভীর আংশিকভাবে বিদ্যমান প্রোথিত অধিবিদ্যাগত ভয়ের উপশমের উদ্দেশ্যে। এ ব্যাপারে যদি কারও সন্দেহের উদ্রেক হয় তাহলে নিচের স্তুতিবাক্য সম্পর্কে চিন্তা করতে পারেন :
আমার পরিচয় প্রাচীন শিলায়
আমি তারই মাঝে লুকিয়ে থাকি
জেস্যু আমার আত্মার আত্মীয়।
আমায় যেতে দাও তার বুকে
পানি যখন গড়িয়ে যায়।
আর তীব্র হয় উতলা হাওয়া
এমন ধারণা আছে যে চূড়ান্ত ক্ষমতা নিহিত রয়েছে স্বর্গীয় ইচ্ছার কাছে। আত্মসমর্পণের মধ্যে। এর ফলে ধর্মীয় মর্যাদাবোধ হ্রাস পেয়েছে অনেক শাসকের মধ্যে। শুধু পার্থিব শক্তির কাছে এমন শাসকরা মাথানত করতে অপারগ। সর্বপ্রকার বশ্যতার মূলে রয়েছে ভয়, তা মানুষ অথবা স্বর্গীয় যে কোনো সত্তার কাছেই হোক না কেন।
এমন ধারণা আজকাল স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে আক্রমণের মূলেও রয়েছে ভীতি। এই তত্ত্বটি অনেক দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে এ কথা ভাবতে আমি বাধ্য। এটি বিশেষ ধরনের আক্রমণের বেলায় সত্য। উদাহরণস্বরূপ ধরা যেতে পারে D.H. Lawrence-এর আক্রমণ। কিন্তু আমার সন্দেহ হয় যে, যেসব মানুষ দস্যুপ্রধান হয়েছে তারা কি তাদের পিতার চরম ব্যবহারে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল অথবা Austerlitz-এ নেপোলিয়ান কি ভেবেছিলেন যে তিনি মেডাম মেয়ারের উপরও প্রতিশোধ নিচ্ছেন! আমি কিছুই জানি না এটিলার মা সম্পর্কে। তিনি তার প্রিতমের ক্ষতিসাধন করেছিলেন বলে আমার সন্দেহ হয়, পরবর্তী সময়ে দুনিয়া যার কাছে অস্বস্তিকর বলে মনে হতো। কারণ তা সময় সময় বাধা সৃষ্টি করত তার খেয়াল-খুশির উপর। আমি এটা মনে করি না যে বড় বড় নেতার মাঝে ভীতি থেকে এমন আক্রমণ প্রবণতা উৎসাহ যোগায়। আমার বলা উচিত বাহ্যিকভাবে নেতাদের ভেতর আত্মবিশ্বাস বিরাজ করে না, বরং তা তাদের অবচেতন মনের অনেক গভীরে অবস্থান করে।
বিভিন্নভাবে সৃষ্টি করা যেতে পারে নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস। ঐতিহাসিকভাবে এটি হচ্ছে হুকুমের উত্তরাধিকার অবস্থান। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখা যায় সংকটকালে রানী এলিজাবেথের ভাষণ। আপনি দেখবেন, রাজা ভদ্রমহিলাকে প্রভাবিত করে তার মাধ্যমে জাতীয় মনের প্রত্যয় সৃষ্টি করেছেন যে কি করতে হবে তা তিনি জানেন। অথচ তা জানার আশা করতে পারে না সাধারণ মানুষ। তার বেলায় সঙ্গতিপূর্ণ হলো জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌম ক্ষমতার স্বার্থ। এ জন্যই মহান রানী তিনি। ঘৃণার উদ্রেক না করেই তিনি করতে পারতেন পিতার গুণকীর্তন। নিঃসন্দেহে দায়িত্ব পালন ও ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর করে আদেশদানের অভ্যাসই। অধিকাংশ নির্বাচিত প্রধানের চেয়ে বংশগত গোষ্ঠীপতির অনুসরণ করে কোনো উপজাতির ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল অর্জন সম্ভব। অপরদিকে ব্যক্তির গুণাগুণের ভিত্তিতে মধ্যযুগীয় চার্চের মতো সংগঠনগুলোতে নেতা নির্বাচন করা হতো, যারা ভালো ফল লাভ করতেন বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে বংশগত রাজতন্ত্রের চেয়ে।