ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম ব্যক্তিদের সংখ্যা সীমিত রাখার জন্য যেখানে অভিজাততন্ত্র বা রাজতন্ত্রের মতো কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান নেই সেখানে তাদের জন্য ক্ষমতা অর্জন খুব সহজ যাদের ক্ষমতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। রয়েছে। মূলত ক্ষমতা যে সমাজ ব্যবস্থায় সবার জন্য উন্মুক্ত সে সমাজে ক্ষমতাকেন্দ্রিক পদগুলো অসাধারণ ক্ষমতালিম্পু ব্যক্তিদের হাতে চলে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানব স্পৃহাগুলোর ভেতর ক্ষমতালিপ্সা অন্যতম হলেও তা সামঞ্জস্যহীনভাবে সমাজে বন্টিত হয়ে আছে এবং তা সীমিত হয়ে পড়ে ভিন্ন। ধরনের অন্যান্য স্পৃহা, যেমন আনন্দপ্রিয়তা, আরামপ্রিয়তা ও অনুমোদনপ্রিয়তা দ্বারা। এটি সুযোগ বাড়িয়ে দেয় আনুগত্যের ছদ্মাবরণে বিরাজ করা ভীরুলোকদের ভেতর সাহসি ব্যক্তিদের ক্ষমতা বিস্তারে। ক্ষমতালিপ্সা যাদের প্রবল নয় তাদের প্রভাব ঘটনাপ্রবাহের উপর খুবই কম। সাধারণত তারাই সমাজে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম যারা সমাজ পরিবর্তনের তীব্র আশা পোষণ করে। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতালিপ্সা। একে আমরা একমাত্র মানবশৃহা বলে গণ্য করলে অবশ্যই ভুল হবে। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানের কার্যকারণ সূত্রগুলো অন্বেষণের ফলে যা ঘটে থাকে এ ভুল হয় এক্ষেত্রে আমাদের এমন বিপথগামী করবে না। ক্ষমতালিপ্সাই হলো প্রধান স্পৃহা যার ফলে পরিবর্তন সাধিত হয়। তাই তার আলোচনা করা সমাজবিজ্ঞানে একান্ত প্রয়োজন।
বিভিন্ন প্রকার ক্ষমতার সাপেক্ষে শুধু সমাজ গতিবিজ্ঞানের সূত্রগুলো বর্ণনা করা সম্ভব। এই সূত্রগুলো আবিষ্কারের জন্য প্রথমত ক্ষমতার শ্রেণিবিভাগ এবং পরে ব্যক্তি বা সংগঠন দ্বারা মানবজীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জনের পন্থা সংবলিত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তে পর্যালোচনা প্রয়োজন।
এ পুরো বইয়ে আমার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য থাকবে পরামর্শদানে। আমি বিশ্বাস করি যে সামাজিক পরিবর্তনের সাধারণ বিশ্লেষণ অধিকতর সমৃদ্ধ অর্থনীতিবিদদের প্রদত্ত শিক্ষা অপেক্ষা। বর্তমান ও নিকট-ভবিষ্যৎকে অধিকতর বোধগম্য করে তোলা প্রয়োজন অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের চেয়ে। বিভিন্নভাবে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল ওই শতাব্দীগুলো। অনেকভাবে আমরা বিগত যুগের জীবনধারা ও চিন্তাধারায় প্রত্যাবর্তন করছি বলে মনে হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস আলোচনা এ যুগ ও এর প্রয়োজন বুঝতে হলে অপরিহার্য। আমরা সম্ভাব্য অগ্রগতি শুধু তখনই অর্জন করতে পারব যখন তা ঊনবিংশ শতাব্দীর স্বতঃসিদ্ধতার অযৌক্তিক প্রভাবে প্রভাবিত হবে না।
০২. নেতা ও অনুসারী
দুই ধরনের প্রেরণা ক্ষমতা লাভের একটি নেতাদের ভেতর স্পষ্ট, অন্যটি অনুসারীদের ভেতর প্রচ্ছন্ন। নেতার নেতৃত্বাধীন দল কর্তৃক ক্ষমতা অর্জন করাই হচ্ছে কোনো নেতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুসরণ করার উদ্দেশ্য। কারণ তারা নেতার সাফল্যেই তাদের সাফল্য মনে করে। বিজয় লাভের লক্ষ্যে অধিকাংশ লোকই নেতৃত্বদানে নিজের যোগ্যতার ভরসা করতে পারে না। তাই তারা শ্রেষ্ঠত্ব। অর্জনের প্রয়োজনীয় সাহস ও বিচক্ষণতা আছে এমন এক ব্যক্তিকে তাদের দলের নেতা বানাতে চায়। এমনকি এই আবেগ ধর্মের বেলায়ও বিদ্যমান। নিয়েজেক খ্রিস্টবাদকে জোরপূর্বক দাসনীতির ধারণা জন্মাবার জন্য দোষারোপ করেছে। কিন্তু লক্ষ্য ছিল সবসময় সর্বশেষ বিজয়ের। মহিমান্বিত ব্যক্তিরাই ভদ্র কারণ তারাই পৃথিবী পাবে, অথবা
যুদ্ধে যাবে দেবতাপুত্র
রাজমুকুট পাওয়ার আশায়
স্রোতের বানে তার রক্তাক্ত বেনার ভাসে
তার ট্রেনে যে যাবে।
যুদ্ধের সরাব ভার যে পান করে
সবার উপরে বিজয়ী দেব।
এই-ই যদি দাসনীতি হয় তাহলে দাস হিসেবে বিবেচিত হবেন সমরাভিযানে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালনকারী সৈনিক ও নির্বাচনে কঠোর পরিশ্রমী রাজনীতিকদের সবাই। প্রকৃতপক্ষে খাঁটি সমবায় উদ্যোগের অনুসারীরা দাস নন, নেতা।
এজন্য মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে সংগঠনের আওতাভুক্ত ক্ষমতা অসম বন্টন মেনে নেবার। ক্ষমতার এই অসম বন্টন সমাজ প্রগতির সঙ্গে বাড়বে বই কমবে না। যতদূর জানা যায় মানব সমাজে ক্ষমতার এই অসমবন্টন সব সময়ই ছিল। এটি ঘটে থাকে আংশিকভাবে বাহ্যিক প্রয়োজনে এবং আংশিকভাবে তা মানুষের স্বভাবজাত কারণে। অধিকাংশ সমবায় উদ্যোগ সম্ভব হয়ে ওঠে একমাত্র প্রশাসনিক বোর্ডের পরিচালনার মাধ্যমে। যেমন কোনো বাড়ি তৈরি করতে হলে কাউকে না কাউকে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে; রেললাইনে রেলগাড়ি চালাতে হলে তার সময়সূচি ড্রাইভারের খামখেয়ালির উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না; নতুন রাস্তা তৈরি করতে হলে রাস্তাটি কোথায় যাবে তা কাউকে স্থির করতে হবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হলেও সরকার সরকারই। সুতরাং যে ক্ষেত্রে মনস্তত্ত্বের সম্পর্ক অনুপস্থিত সে ক্ষেত্রে সমবেত উদ্যোগ সার্থক করার জন্য কিছু সংখ্যক মানুষ এমন থাকবে যারা নেতৃত্ব দেবে এবং অন্য মানুষেরা নেতৃত্ব মেনে নেবে। কিন্তু আসল ঘটনা এই যে, প্রকৃত অসম ক্ষমতা কৌশলগত কারণে অনিবার্য মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এই সত্য ব্যাখ্যা করা যেতে পারে শুধু মনোবিদ্যা ও শরীরবিদ্যা সাপেক্ষে। কিছু মানুষের চরিত্র এমনই যে তারা নির্দেশ প্রদান করে এবং তা সর্বদা অন্য লোকেরা পালন করে। কোনো কোনো অবস্থায় এই দুই চরম অবস্থার মাঝামাঝি লোকজন আদেশ প্রদান করে, কিন্তু ভিন্ন অবস্থায় নেতার অনুগত হওয়াই পছন্দ করে।