ক্ষমতা ও গৌরব হলো মানুষের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার ভেতর প্রধান। যদিও এগুলো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত কিন্তু অভিন্ন নয়। মর্যাদার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বেশি। অন্যদিকে ক্ষমতার চেয়ে রাজার মর্যাদা বেশি। সে যাই হোক গৌরব অর্জনের সহজতম পথ হচ্ছে আগে ক্ষমতা লাভ করা। এটা তাদের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য যারা জাতীয় ঘটনা নিয়ে কাজ করেন। সুতরাং গৌরব ও ক্ষমতালাভের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে একই কাজ সমাধান উদ্বুদ্ধ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবে এটা দুটো উদ্দেশ্য বিবেচিত হয় অভিন্ন বলে।
গোঁড়া অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে মার্কস এ বিষয়ে একমত যে, তিনি এবং গোড়া অর্থনীতিবিদরা ভুল করেছেন অর্থ-সম্পর্কীয় স্বার্থকে সমাজবিজ্ঞানের মূল ও চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। ক্ষমতা ও মর্যাদা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে সীমাহীন নয় সম্পদ লাভের আকাঙ্ক্ষা, বরং তা পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করতে পারে সীমিত সরবরাহ দ্বারা। বস্তুগত উপভোগের সাপেক্ষে বোঝা যায় না প্রকৃত ব্যয়বহুল আকাঙ্ক্ষা। এইসব সম্পদ অন্যায়ভাবে অধীনস্ত হয়ে পড়ে আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইন বলে এবং সিনেমা গ্যালারিগুলো দক্ষ কুশলীদের দ্বারা একান্ত পুরনো প্রভুদের জন্য নির্ধারিত হয়। ক্ষমতা ও গৌরব বাড়ানোর জন্যই এ সব কিছুই করা হয়–আয়েশে বসার জন্য নয়। ক্ষমতা অনুসরণ করা হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয় পর্যায়েই পরিমিত উপভোগের নিশ্চয়তা পেলে, সম্পদ নয়। তারা সম্পদের পরিবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে ক্ষমতার জন্যই সম্পদের সন্ধান করে অথবা ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু পূর্বোক্ত বিষয়টিতে শেষোক্ত বিষয়টির মতো মূল চালিকা শক্তি অর্থনীতি হয়।
এই ভুলটি গোঁড়া অর্থনীতিবিদ ও মার্কসীয় অর্থনীতিবিদদের শুধু তত্ত্বীয় দিক থেকে নয় বরং তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক দিক থেকেও এবং আধুনিক ঘটনাপ্রবাহকে ভ্রান্তির বেড়াজালে–ই প্রবিষ্ট করেছে। যদি মনে করা হয়, ক্ষমতার মোহই সামাজিক বিষয়গুলোর দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে, একমাত্র তাহলেই সম্ভব সঠিকভাবে আধুনিক অথবা প্রাচীন ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ।
সমাজবিজ্ঞানের মূল ধারণা ক্ষমতা-আমি এই বইয়ের পরবর্তী পর্যায়ে এই সত্যটি প্রমাণ করার চেষ্টা করব। শক্তি যেমন পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারণা তেমনি ক্ষমতা সমাজবিজ্ঞানের মূল ধারণা। ক্ষমতাও শক্তির মতো প্রকারভেদ আছে। যেমন সম্পদ, যুদ্ধাস্ত্র, বেসামরিক কর্তৃত্ব এবং মতামতের উপর প্রভাব। তবে এমন ভাবা যাবে না যে এগুলো একটা আরেকটার অধীন। এর কোনোটি অন্যটি থেকে উদ্ভূতও নয়। অবশ্য এ কথা সত্য যে, আংশিক সফলতা আনবে পৃথকভাবে যে কোনো এক প্রকার ক্ষমতার আলোচনা। ক্ষমতার একটি বিশেষ রূপের আলোচনা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে থাকে অন্যগুলো আলোচনার বাইরে রাখলে। সম্পদ লাভ করা যেতে পারে মিলিটারি ক্ষমতা ও মতামতের উপর প্রভাব থেকে। ঠিক একইভাবে এগুলোর যে কোনো একটি সৃষ্টি করা যায় সম্পদ থেকে। শুধু ক্ষমতার সাপেক্ষে সমাজ গতিবিজ্ঞানের সূত্রগুলো বর্ণনা করা যায় ক্ষমতার বিশেষ রূপের সাপেক্ষে নয়। মিলিটারি ক্ষমতা আগের দিনগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে ছিল এবং পরিচালকের আকস্মিক দক্ষতার উপর নির্ভর করতে যুদ্ধের জয় পরাজয়। আমরা এ যুগে মনে করি অন্যসব ক্ষমতা বেরিয়ে আসবে অর্থনৈতিক ক্ষমতা থেকে। আমি বলতে চাই, মিলিটারি ইতিহাসবিদদের অনেকের এটিও একটি বড় ধরনের ভুল যে, এটি তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে অচল ভাবতে। আবার অনেকেই প্রচালনাই ক্ষমতার মৌলিক রূপ বলে মনে করেন। অবশ্য কোনো নতুন ধারণা নয় এটি। এটি শহীদের রক্তই চার্চের ভিত্তি এই প্রচলিত ধারণাই ভেতর জীবন্ত হয়ে ওঠে। এতে মিলিটারি এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের মতোও প্রায় সমপরিমাণ সত্য ও মিথ্যার আশ্রয় রয়েছে। প্রচারণা সমাজে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে যদি তা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। কিন্তু প্রচারণার উদ্দেশ্যে ইচ্ছা করলে তারা এটি ব্যবহার করতে পারেন যাদের হাতে মিলিটারি বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অবশ্য পদার্থবিজ্ঞানের অনুরূপ আলোচনায় যদি ফিরে যাই তাহলে দেখব, ক্ষমতাও শক্তির মতো বারবার রূপান্তর ঘটায় এবং এই সব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যে নিয়ম বিদ্যমান তার অনুসন্ধান করা সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হওয়া উচিত। আমাদের এ যুগে ক্ষমতার যে কোনো রূপকে আলাদা করে দেখা, বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষমতা আলাদাভাবে দেখার ফলে ভুলের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস্তব গুরুত্বের অধিকারী।
ক্ষমতার সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে বিভিন্ন সমাজের পার্থক্য। তাদের পার্থক্য হয়ে থাকে ব্যক্তি ও সংগঠন কর্তৃক অর্জিত ক্ষমতার পরিমাণের ভিন্নতার জন্যে। এ কথা সত্য যে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সংগঠনের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যেই বর্তমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অনেক বেশি। আবার এগুলোর পার্থক্য সৃষ্টি হয় সর্বাদিক প্রভাবশালী সংগঠনগুলোর ভিন্নতা সাপেক্ষে। যেমন মিলিটারি, স্বৈরতন্ত্র, ধনতন্ত্র, দিব্যতন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। তাদের পার্থক্য সৃষ্টি হয় ক্ষমতা অর্জনের পদ্ধতিগত ভিন্নতার জন্যে। এক ধরনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয় উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রাজতন্ত্র; অন্য এক প্রকার ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয় রাজকীয় ব্যবস্থা; গণতন্ত্র তৃতীয় এবং যুদ্ধ চতুর্থ প্রকারের ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয়।