হিল্ডার ব্রান্ডের পূর্বের ধারণাগুলোর অন্যতম হলো যাজকীয় কৌমার্য। তা বলবৎ করার জন্য তিনি একটি তালিকা প্রস্তুত করেন যাজক ও তাদের স্ত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের অপরাধী ব্যক্তিদের। অবশ্য এই অভিযান পুরোপুরি সফল হয়নি। স্পেনে আজও তা সফল হয়নি, কিন্তু এর উদ্দেশ্যগুলোর ভেতর একটি অর্জিত হয়। তা ছিল এই যে, যাজকীয় পদে যাজকদের ছেলেমেয়েদের অধিষ্ঠিত করা যাবে না। ফলে বংশগত উত্তরাধিকার প্রথা রহিত হয় স্থানীয় যাজকত্বে।
১০৫৯ সালে রায়ের মাধ্যমে পোপ নির্বাচনে বিধিমালা প্রণয়ন ছিল সংস্কার আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। এই রায়ের আগে সম্রাট ও জনগণের কিছু অনির্দিষ্ট অধিকার ছিল। এর ফলে সৃষ্টি হতো অনৈক্য এবং পুনরাবৃত্তি ঘটত বিতর্কিত নির্বাচনের। অবিলম্বে তা সগ্রাম ছাড়া হয়নি বটে, কিন্তু সফল হয় নতুন রায় নির্বাচনের অধিকার বিশপদের হাতে সীমাবদ্ধ রাখতে।
চলমান সংস্কর আন্দোলন একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধব্যাপী এবোট, বিশপ ও আর্কবিশপকে সামন্ত অভিজাত শ্রেণি থেকে পৃথক করতে এবং পোপকে তাদের নিযুক্তির ব্যাপারে ক্ষমতা প্রদান করতে সফল হয়। কারণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হলে পোপ স্বাভাবিকভাবেই কলঙ্কের সম্মুখীন হতেন ঘুষের ব্যাপারে। এর ফলে জনসাধারণ প্রভাবিত হলো এবং চার্চের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল। যাজক সম্প্রদায় স্পষ্টতই অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে পৃথক হয়ে পড়ে কৌমার্য প্রথা আরোপের ফলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কঠোর তপস্যার মতো নিঃসন্দেহে তাদের ক্ষমতা তাড়না উদ্দীপিত হয়। নেতৃস্থানীয় যাজকদের ভেতর তা একটি উদ্দেশ্যে নৈতিক আগ্রহের সঞ্চার করে। প্রচলিত দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান ব্যক্তিরা ছাড়া সবাই এ উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাসী ছিল এবং এ উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল উন্নতি বিধানের প্রধান উপায় হিসেবে পোপের প্রভূত ক্ষমতা বৃদ্ধিও।
প্রথমদিকে সাধারণত প্রচারণার উপর নির্ভরশীল ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন হয় এ ক্ষেত্রের মতো অসাধারণ সাহস ও আত্মোৎসর্গের। কিন্তু শ্রদ্ধা অর্জিত হওয়ার পর এসব গুণাবলি পরিত্যাগ করা যেতে পারে এবং জাগতিক উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে শ্রদ্ধা। এরপর সময়ের সাথে শ্রদ্ধা হ্রাস পায় এবং এর মাধ্যমে অর্জিত সুবিধাগুলো হারিয়ে যায়। কখনও এই প্রক্রিয়া কয়েক বছর স্থায়ী হয়, আবার কখনও হাজার বছর। কিন্তু মূলগতভাবে তা সবসময় একই ছিল।
শান্তিপ্রিয় ছিলেন না ৭ম গ্রেগরি। অভিশপ্ত সে-ই যে তার তলোয়ার রক্তপাত থেকে ফিরিয়ে রাখে ছিল তার প্রিয় কথা। কিন্তু তিনি এর ব্যাখ্যা দেন দেহধারী মানুষের ভেতর প্রচারণা থেকে বিরত থাকার উপায় নিষিদ্ধকরণ সম্বন্ধে এবং প্রদর্শন করেন প্রচারণা ক্ষমতার উপর তার দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিকতা।
ইংরেজদের ভেতর পোপের চেয়ার দখল করেন একমাত্র নিকোলাস ব্রেক্সপিয়ারই। তিনি অন্যভাবে দেখান পোপের ধর্মীয় ক্ষমতা। এবিলার্ডের ছাত্র ব্রেসিয়ারের আর্নল্ড এই মতবাদ প্রচার করেন যে, ভূসম্পত্তি আছে যে পাদ্রির, জায়গির ভোগ করেন যে বিশপ এবং সম্পদ আছে যে সন্ন্যাসীদের অধিকারে তারা কেউই রক্ষা পাবে না। এ মতবাদ অবশ্য গোঁড়া ছিল না। সেইন্ট বার্নার্ড তার সম্বন্ধে বলেন, যে ব্যক্তি পানাহার করে না সে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকে শয়তানের মতো শুধু আত্মার রক্তের জন্যে। তা সত্ত্বেও সেইন্ট বার্নার্ড স্বীকার করেন তার দৃষ্টান্তমূলক ধার্মিকতা। ফলে তিনি পক্ষ অবলম্বন করেন পোপ ও মৌলবাদীদের সঙ্গে পরিচালিত সংগ্রামে কার্যকরভাবে রোমানদের। ১১৪৩ সালে রোমানরা এদেরকে নির্বাসনে প্রেরণ করতে সমর্থ হয়। তিনি সমর্থন দান করেন তার মতবাদের নৈতিক প্রেরণা সন্ধানী পুনরুত্থিত রোমান প্রজাতন্ত্রের। কিন্তু একজন মৌলবাদীকে হত্যার ফলে সৃষ্ট সুযোগ গ্রহণ করে চতুর্থ অর্ডিয়ান (ব্রেক্সপিয়র) পবিত্র সপ্তাহে রোমে ধর্মকর্ম নিষিদ্ধ করে দেন। ধর্মীয় সন্ন্যাসীরা পবিত্র শুক্রবার আসন্ন হলে জোরপূর্বক সিনেট দখল করে নেয়। শোচনীয় বশ্যতা মেনে নেয় সিনেট। আর্নল্ডকে গ্রেফতার করা হয় সম্রাট ফ্রেডারিক বারবারসার সাহায্যে। ফাঁসি দিয়ে তার দেহ পুড়িয়ে ছাইভস্ম তাইবার নদীতে ফেলে দেয়া হয়। যাজকদের যে ঐশ্বর্যলাভের অধিকার আছে এভাবে তা প্রমানিত হয়। পুরস্কারস্বরূপ পোপ সম্রাটকে সেইন্ট পিটারের মুকুট পরিয়ে দেন। ক্যাথলিক বিশ্বাসের মতো এত উপকারী না হলেও সম্রাটের সেনাদল প্রয়োজনীয় ছিল। সম্রাটের সেনাদলের কাছে চার্চের ক্ষমতা সম্পদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ সমর্থনের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ঋণী।
ব্রেসিয়ারের আর্নল্ডের মতবাদের বিষয়বস্তু চিল পোপ ও সম্রাটের ভেতর পারস্পরিক সমন্বয় বিধান। কারণ প্রত্যেকেই স্বীকার করে যে উভয়ের প্রয়োজন ছিল প্রতিষ্ঠিত প্রথার জন্যে। কিন্তু অনিবার্য দ্বন্দ্বটি নতুনভাবে দেখা দিল আর্নল্ড ক্ষমতাচ্যুত হলে। উদ্ভূত এই দীর্ঘ সংগ্রামে লম্বার্ড লীগ নামে এক নতুন সহযোগী পেলেন পোপ। লম্বার্ডির শহরগুলো বিশেষত মিলান সমৃদ্ধ ও বাণিজ্যিক দিকদিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখনকার দিনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্মুখভাগে ছিল ওইগুলো। স্বীকৃতিস্বরূপ ইংরেজরা একে লম্বার্ড স্ট্রিট নামে স্মরণ করে থাকে। সামন্তবাদের পক্ষে দাঁড়ালেন সম্রাট, কিন্তু ইতিমধ্যেই এর বিরোধী হয়ে গের বুর্জোয়া পুঁজিবাদ। চার্চ সুদ নিষিদ্ধ করলেও পোপ ঋণগ্রহীতা ছিলেন এবং উত্তর ইতালীয় ব্যাংকের মুলধন এত উপকারী দেখতে পেলেন যে অবশেষে ধর্মীয় কঠোরতা হ্রাসের প্রয়োজন মনে করেন। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে বারবারসার সঙ্গে পোপের দ্বন্দ্ব চলে এবং তা শেষ হয় অমীমাংসিতভাবে। সম্রাটের জয়ী না হওয়ার প্রধান কারণ লম্বার্ড শহরগুলোই।