বর্বর আক্রমণের পর প্রথম ছয় শতাব্দী ধরে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি পশ্চিমা চার্চ দাঙ্গাবাজ ও আবেগপ্রবণ জার্মান রাজাদের এবং বেরনদের সঙ্গে। এই জার্মান রাজা ও বেরনরাই শাসন করত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও উভয় ইতালি এবং খ্রিস্টীয় স্পেন। জাস্টিনীয়দের বিজয় ছিল এর কিছু কারণ। একবার পৌরহিত্যিক বাইজেন্টাইন প্রতিষ্ঠা করে নেয় এই বিজয় এবং পশ্চিমে এর প্রভাব যথেষ্ট কমিয়ে দেয়। তারা নিয়োগ করত বিদেশি ও দূরবর্তী পোপদের চেয়ে যাদের সঙ্গে তারা অধিকতর একাত্ম বলে নিজেদের মনে করত সেই সমস্ত অভিজাত শ্রেণির ভেতর থেকে উচ্চমান পাদ্রিদের। কারণ তারা অপমানজনক মনে করত বিদেশি ও দূরবর্তী পোপদের হস্তক্ষেপ। অধিকাংশ নিম্নমান পাদ্রিরা ছিল অজ্ঞ এবং বিবাহিত। তাই তারা বেশি উদগ্রীব ছিল তাদের অধিকারভুক্ত সম্পত্তিগুলো চার্চের সংগ্রামের চেয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে হস্তান্তরের জন্যে। এত কষ্টকর ছিল যাতায়াত যে দুরবর্তী রাজ্যগুলোতে রোমান কর্তৃত্ব আরোপ করা যেত না। পোপের বিশাল এলাকার উপর প্রথম কার্যকর সরকার ছিল না, বরং তা ছিল শার্লিম্যানের, যা প্রশ্নাতীতভাবে পোপের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন তার সমসাময়িক ব্যক্তিরা।
সভ্যতার দ্রুত উন্নতি হতে লাগল তখন যখন দেখা গেল যে এক হাজার সালের পর বিশ্বের আকাঙ্ক্ষিত পরিসমাপ্তি ঘটেনি। পান্ডিত্যপূর্ণ দর্শনের উন্নতি ত্বরান্বিত হয় স্পেন ও সিসিলির মুরদের সঙ্গে সংস্পর্শে। সমসাময়িক শিক্ষা যা দিতে পারত নরম্যানরা ফ্রান্স ও সিসিলিতে তা ভোগ করল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জলদস্যুদের অত্যাচার ভোগ করে এবং বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে গড়ে উঠল সুশৃঙ্খল ধর্মীয় শক্তি। অধিকন্তুজকীয় কর্তৃত্ব কার্যকরি দেখতে পেল বিজয়। বৈধকরণে। সর্বপ্রথম তাদের দ্বারা যাজকীয় ইংল্যান্ড পুরোপুরিভাবে রোমের অধীনস্ত হলো। ইতিমধ্যে প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় সবচেয়ে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হলেন ফ্রান্সের রাজা ও সম্রাট উভয়ই। ঐ অবস্থায় যাজকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে শুরু করে গ্রেগরি-৭-এর নির্দয় শক্তি ও রাজনীতি এবং তা স্থায়ী হয় পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে। এই যুগ যাজকীয় ক্ষমতার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত বিধায় আমি তা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব।
পোপীয় শাসনের দিনগুলোর সূত্রপাত হয় গ্রেগরি-৭ এর সিংহাসন আরোহণের সঙ্গে এবং তা স্থায়ী হয় এভিগননে ক্লিমেন্ট-৫ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত পোপীয় শাসন ১৩০৬ খ্রিঃ পর্যন্ত। এই যুগে পোপের বিজয় অর্জিত হয় আধ্যাত্মিক অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা। অর্থাৎ অস্ত্রবলে নয় বরং কুসংস্কার দ্বারা। যুগব্যাপী পোপগণ নির্ভরশীল ছিলেন বাহ্যত নগরের বিদ্রোহাত্মক অভিজাত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত রোমের আন্দোলনমুখী জনগণের আগ্রহের উপর। কারণ খ্রিস্টান জগতের বাকি অংশ যা-ই ভাবুক না কেন, রোমানরা তাদের পোপের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। মহান হিলডিব্র্যান্ড নির্বাসনে মারা গিয়েছিলেন বটে কিন্তু তিনি অর্জন করেছিলেন ক্ষমতা এবং তা মহান শাসকদের অপদস্ত করতে হস্তান্তর করেছিলেন। সম্রাট হেনরি-৪ এর জন্য এর অব্যবহিত রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো সুবিধাজনক হলেও ক্যানোসা পরবর্তী যুগগুলোর জন্য তা প্রতীক হয়ে রইল। বিসমার্ক কুলটার ক্যাম্পের সময় বলেছিলেন, কেনোসায় আমরা যাব না। কিন্তু অকাল গর্বই করেছিলেন তিনি। হেনরি-৪, যিনি সমাজচ্যুত হয়েছিলেন তিনি তার পরিকল্পনা অগ্রসর করে নেয়ার জন্য পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন। যদিও গ্রেগরি অনুশোচনাকারীকে পাপমুক্ত করে দিতে অগ্রাহ্য করতে পারননি তারপও মর্যাদাহানিকর শর্তারোপ করেন চার্চের সঙ্গে মীমাংসার মূল্য হিসেবে। মানুষ রাজনীতিবিদ হিসেবে পোপের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে পারে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে শুধু প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদীরাই, এমনকি সম্রাট ফ্রেডারিক-৩ পোপের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চরম পর্যায়েও প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে প্রদান করতে পারেননি নৈতিক সমর্থন।
যাজকীয় সংস্কার চরম পর্যায়ে পৌঁছে ৭ম গ্রেগরির পোপীয়কালে। সম্রাটের অবস্থান তার আগে পোপের উপরে ছিল এবং সম্রাট পোপ নির্বাচনে সিদ্ধান্তকারী ভূমিকার দাবি করতেন। ৬ষ্ঠ গ্রেগরিকে হেনরি-৪ এর পিতা হেনরি-৩ ঘুষ সম্বন্ধীয় অপরাধের জন্য ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং তার স্থলে পোপের পদে বসান একজন জার্মান ব্যক্তিকে। তিনি ছিলেন ক্লিটমেন্ট-২। তারপরও হেনরি-২ চার্চের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত ছিলেন না। অপরদিকে তিনি ছিলেন তাপস ব্যক্তি। তিনি তার সময়ের হিংসাপরায়ণ যাজক ব্যক্তিদের সঙ্গে এক কাতারে থাকতেন। তার সমর্থিত এবং গ্রেগরি-৭-এর দ্বারা বিজয়মণ্ডিত সংস্কার আন্দোলন অপরিহার্যরূপে সমাজতন্ত্রের দ্বারা কলুষিত হওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। রাজা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সামন্ত অভিজাত শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিদের ভেতর থেকে আর্কবিশপ ও বিশপ নিযুক্ত করতেন, যারা তাদের অবস্থানের একটি লৌকিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। মুলত সম্রাটের অধীনে রাজকর্মচারী ছিলেন সাম্রাজ্যস্থিত সবচেয়ে মহান ব্যক্তিরা এবং রাজপদের বলেই তারা জমির উপর তাদের অধিকার বজায় রাখেন; কিন্তু একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে তারা বংশগতভাবে অভিজাত শ্রেণিভুক্ত হন, যাদের মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে বংশ পরম্পরায় হস্তান্তরিত হতো। চার্চের অভ্যস্তরে বিশেষত নিম্নমান লৌকিক পাদ্রিদের একটি বিপদ চিল। চার্চের সংস্কারক দল আক্রমণ চালায় চার্চের ভেতরকার ঘুষ ও উপপত্নীগ্রহণ নামীয় সমজাতীয় পাপাচারের উপর। তাদের অভিযানে তারা উৎসাহ, সাহস ও নিষ্ঠা এবং জাগতিক জ্ঞানের পরিচয় দেন। তারা পবিত্রতার দ্বারা জনসাধারণের সমর্থন লাভ করেন এবং বাগ্মিতার দ্বারা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর জয়লাভ করেন, যারা মূলত শত্রুভাবাপন্ন ছিল। উদাহরণস্বরূপ ১০৫৮ সালে মিলানে সেন্ট পিটার পাদ্রিদেরকে আহ্বান করেন ডমিয়ান রোমের সংস্কারমূলক রায়ের প্রতি বাধ্য হতে। তিনি প্রথমে এতই উত্তেজিত হন যে তার জীবন বিপদাপন্ন ছিল। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। দেখা যায় যে, ব্যক্তিগতভাবে ঘুষের অপরাধে অপরাধী ছিলেন আর্কবিশপ থেকে নিচের দিকে মিলনিজদের প্রত্যেক যাজকই। সবাই তাদের দোষ স্বীকার করল এবং ভবিষ্যতে বাধ্য থাকার জন্য প্রতিজ্ঞা করল। এসব শর্তে তাদেরকে বেদখল করা হলো না। তবে এ কথা পরিষ্কার করা হলো যে ভবিষ্যতে এ রকম অপরাধের শাস্তি কোনোরকম অনুকম্পা ছাড়া প্রযোজ্য হবে না।