গণতন্ত্রে এক ধরনের মানুষের হস্তগত রাজনৈতিক ক্ষমতা, যারা এ পর্যন্ত আলোচিত তিন ধরনের মানুষ থেকেও ভিন্ন প্রকৃতির। একজন রাজনীতিককে সফলকাম হতে হলে অবশ্যই তার সংগঠনের আস্থা অর্জন করতে হবে এবং সফল হতে হবে অধিকাংশ ভোটারের ভেতর উৎসাহ সৃষ্টিতে। ক্ষমতা অর্জনের জন্য এই দুই স্তরের প্রয়োজনীয় গুণাবলি এক প্রকার নয়। এর যে কোনো একটির অধিকারী হয় বেশিরভাগ মানুষই। এ রকম বিরল ব্যক্তিত্ব নন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা। যদিও তারা সাধারণ মানুষের ভেতর ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে পারেন না, তারপরও তারা দক্ষ পার্টির ব্যবস্থাপকদের অনুগ্রহ অর্জনে। এসব মানুষ সাধারণভাবে পরাজিত হন, কিন্তু তাদের পরাজয়ের পূর্বাভাস বোঝাতে পারেন না দলীয় ব্যবস্থাপকরা। কখনও নির্বাচনে সংগঠন বিজয়লাভ করতে পারে প্রার্থীর ব্যক্তিগত গুণাগুণ ছাড়াই। এ ধরনের ক্ষেত্রে পার্টি তার উপর প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনোত্তর সময়ে। যার ফলে প্রকৃত ক্ষমতা অর্জন করতে তিনি কখনও সক্ষম হন না। পক্ষান্তরে নিজের সংগঠন সৃষ্টি করা যে কারও পক্ষে সম্ভব। এর দৃষ্টান্ত নেপোলিয়ন-৩, মুসোলিনি এবং হিটলার। প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ব্যবহার করে রাজনীতিবিদ সফলতা অর্জন করলেও পরিণামে তিনি একে তার ইচ্ছার অধীনস্ত করে তোলেন এর উপর প্রভাব বিস্তার করে।
একজন রাজনীতিককে যেসব গুণাবলি গণতন্ত্রে সফল করে তোলে তা পরিবর্তিত হয় সময়ের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। এগুলো শাস্তিকালীন এবং বিপ্লব বা। যুদ্ধকালীন সময়ে একরকম নয়। একজন মানুষ সফল হতে পারেন শাস্তি কালীন সময়ে কাঠিন্য ও সুবিচার দ্বারা। কিন্তু এর অধিক গুণাবলি প্রয়োজন হয় শান্তি বিঘ্নিত হলে। এমন সময় প্রয়োজন একজন আকর্ষণীয় বক্তা হওয়ার প্রয়োজন নেই প্রচলিত অর্থে অনিবার্য বাগ্মী হওয়ার। বাগ্মী ছিলেন না রবসপিয়ার এবং লেলিন; কিন্তু তারা ছিলেন স্থিরচিত্ত, আবেগপ্রবণ এবং সাহসী। স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে এই আবেগ, কিন্তু অনুভূত হতে হবে এর অস্তিত্ব। একজন রাজনীতিবিদ সক্ষম হবেন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে যুক্তিনির্ভর বা নৈর্ব্যক্তিক সত্য উপলব্ধি করতে। তিনি অবশ্যই জনগণকে বোঝানোর ক্ষমতা রাখবেন যে তাদের আবেগপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব এবং তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তা অর্জন করতে পারেন দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে।
গণতন্ত্রকে মুছে ফেলে দিয়ে যিনি ডিক্টেটর হয়েছেন তিনিই সবচেয়ে সফল রাজনীতিবিদ। অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রে তা সম্ভব; ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে কেউই তা করতে পারেননি। কিন্তু যখন তা সম্ভব তখন উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে গণতন্ত্রী রাজনীতিবিদদের একমাত্র উচ্চমাত্রায় ওইসব গুণ প্রয়োজন হয়। লেলিন, মুসোলিনি, হিটলার গণতন্ত্রের কাছে ঋণী তাদের উত্থানের জন্য।
একবার যখন ডিক্টেটরি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তা ডিক্টেটরের গুণাবলি ভিন্ন হয়ে থাকে প্রতিষ্ঠাকালে ব্যবহৃত গুণাবলি থেকে। যখন উত্তরাধিকার প্রত্যাখ্যাত হয় তখন গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো নিজে অন্তরালে থেকে অপরের মাধ্যমে ক্ষমতাসাধন, ষড়যন্ত্র এবং কোর্টের পক্ষপাতিত্ব অর্জন করা। এ জন্য প্রতিষ্ঠাকারীর মৃত্যুর পর নিশ্চিতভাবে পরিবর্তিত হয় ডিক্টেটরি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো। যেহেতু প্রতিষ্ঠাকারীর গুণাগুণের চেয়ে উত্তরাধিকারী ডিক্টেটরের গুণগুলো সাধারণভাবে কম আকর্ষণীয় সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই সম্ভাবনা থেকে যায় অস্থিতিশীলতা ও প্রাসাদ বিপ্লবের এবং পরিণামে তা মোড় নেয় অন্য পদ্ধতিতে। যা হোক আশা করা যায়, এই প্রবণতা রোধ করা সম্ভব রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে কোনোরূপ জনপ্রিয় গুণাগুণ প্রর্দশন ছাড়া শুধু আধুনিক প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে তার জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করে। কিন্তু এখনও বলা সম্ভব নয় এ ধরনের পদ্ধতি কতটুকু সফল হবে।
আমরা এ পর্যন্ত আমাদের বিবেচনার বাইরে রেখেছি ব্যক্তিবিশেষের এক ধরনের ক্ষমতার আলোচনা। নেপথ্যে একে ক্ষমতা বলা হয়। এর অন্তর্ভুক্ত হলো সভাসদ, ষড়যন্ত্রকারী, গুপ্তচর এবং ঘটনার অন্তরালে থেকে অন্যের দ্বারা নিজ উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম ব্যক্তির ক্ষমতা। প্রতিটি বড় সংগঠন, যেখানে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিদের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে সেখানে অপেক্ষাকৃত কম খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ থাকে যারা নিজস্ব পদ্ধতিতে প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে নেতাদের উপর। এই একই পর্যায়ভুক্ত হলো ওয়ারপুলার এবং পার্টি কর্তারা, যদিও ভিন্ন ধরনের কৌশল তাদের। আস্থাভাজন বন্ধুদের তারা বসিয়ে দেন লোকচক্ষুর অন্তরালে কৌশলগত স্থানগুলোতে। সুতরাং সময় মতো তারা সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। স্বৈরাচার উত্তরাধিকারমূলক না হলেও স্বৈরাচারীর মৃত্যুর পর এ ধরনের ব্যক্তিরা তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আশা পূরণ করতে পারেন। কিন্তু তারা পছন্দ করেন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকাটাই। তাদের মোহ গৌরবের চেয়ে ক্ষমতার প্রতি বেশি। এ ধরনের ব্যক্তিরা প্রায়ই ভীরু হয়ে থাকেন। কখনও তারা যে কোনো কারণে বঞ্চিত হয় প্রাচ্য রাজতন্ত্রের খোঁজা ব্যক্তি অথবা অন্য জায়গায় রাজার মহীয়সীর মতো নামসর্বস্ব নেতৃত্ব থেকে। তাদের প্রভাব সর্বাদিক উত্তরাধিকারমূলক নামমাত্র ক্ষমতার ক্ষেত্রে। কিন্তু ক্ষমতা থাকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার অস্তিত্ব আধুনিক সরকার ব্যবস্থাপনার যেসব বিভাগে রয়েছে বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, ঐগুলোতে অনিবার্য হয়ে পড়ে তাদের প্রভাব। মুদ্রা ও বিদেশি নীতি হচ্ছে এগুলোর ভেতর এ যুগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেরন হেলেটাইনের প্রভূত ক্ষমতা চিল কায়সার উইলিয়াম-২ এর শাসনকালে। কিন্তু তিনি কখনও আবির্ভূত হননি জনসমক্ষে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী অফিসারদের ক্ষমতা কতটুকু। তবে ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় দলিল থেকে তা জানাতে পারবে আমাদের সন্তানরা। অন্যসব ক্ষমতা থেকে এমন নেপথ্য ক্ষমতা অনেক ভিন্ন। এগুলো সাধারণত অনাকাঙ্ক্ষিত গুণাবলি। এ ধরনের নেপথ্যে ক্ষমতা বিদ্যমান যে শাসন পদ্ধতিতে তা কোনোরূপ অবদান রাখতে পারে না সর্বসাধারণের মঙ্গলার্থে।
০৪. যাজকীয় ক্ষমতা
আমি দুই প্রকার প্রথাগত ক্ষমতা নিয়ে এই অধ্যায় ও পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করব। এই দুই প্রকার ক্ষমতা হচ্ছে–যাজকীয় কর্তৃত্ব ও রাজকীয় কর্তৃত্ব। অতীতকালে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল এগুলো। অধুনা উভয়টিই কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। এর কোনোটিই পুনরুজ্জীবিত হবে না ভাবাটা হঠকারী হতে পারে। উভয় প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সম্ভব করে তোলে এগুলোর স্থায়ী বা অস্থায়ী পতন, যা অর্জিত হওয়ার নয় আরও তেজোবীর্য ক্ষমতার ক্ষেত্রে।