ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় প্রকৃত অথবা অনুমতি শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জিত হলে। প্রথাগত চীন ও ক্যাথলিক চার্চ হচ্ছে এর রকম ক্ষমতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো দৃষ্টান্ত। আধুনিক বিশ্বে অতীতের অধিকাংশ সময়ের চেয়ে তা কমই রয়েছে; চার্চ ছাড়া এ ধরনের ক্ষমতা ইংল্যান্ডে খুব কমই রয়েছে। অধিকাংশ বর্বর সমাজে শিক্ষার মাধ্যমে সঞ্চারিত ক্ষমতার প্রভাব সর্বাধিক। কিন্তু তা নিয়মিতভাবে হ্রাস পায় সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে। আমি শিক্ষা বলতে অন্তর্ভুক্ত করছি মেজিসিয়ান বা মেডিসিনম্যানদের শিক্ষার মতো খ্যাতিমান শিক্ষাকে। লাসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে হলে বিশ বছরের প্রয়োজন। এই ডিগ্রি প্রয়োজন হয় দালাইলামার পদ ছাড়া অন্যসব পদের জন্যে। ইউরোপে এক হাজার সালের বিরাজমান অবস্থাই যথেষ্ট যখন পোপ সিলভিস্টার ২ ছিলেন একজন খ্যাতিমান মেজিসিয়ান। তিনি বই পড়তেন এবং সমর্থ হতেন মেটাফিজিক্যাল ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে চার্চের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে।
আমরা জানি ধর্মযাজকের আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি হরো বুদ্ধিজীবীরাই; কিন্তু তাদের ক্ষমতা হরণ করে নিয়েছে শিক্ষার বিস্তৃতি। বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতা র্নিভর করে কুসংস্কারের উপর; প্রথাগত যাদুমন্ত্র অথবা পবিত্র গ্রন্থের প্রতি শ্রদ্ধা। এগুলোর কিছুটা টিকে আছে ইংলিশ দেশগুলোতে, যা দেখতে পাওয়া যায় রাজ্যাভিষেক ও সংবিধানের প্রতি ইংরেজদের মনোভাবের ভেতর। এখনও প্রথাগত পান্ডিত্য ক্ষমতা আছে কেন্টারবারির আর্কবিশপ ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের। কিন্তু তা শুধু মিসরীয় যাজক ও চৈনিক কনফিউসীয় পন্ডিতদের ক্ষমতার প্রেতাত্মা।
সম্মান যদি ভদ্রলোকের বৈশিষ্ট্যমূলক গুণাগুণ হয় তবে জ্ঞান হবে শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনকারী ব্যক্তির গুণাগুণ। ব্যক্তি বিশেষের পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানভান্ডার, আবেগ-অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও মানবজীবন সম্পর্কে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা প্রয়োজন জ্ঞানের জন্য খ্যাতি অর্জন করতে। মনে হয় এসব গুণাগুণের কিছু কিছু অর্জন করা সম্ভব শুধু বয়সের কারণেই। এজন্যই সম্মানসূচক পরিভাষা হচ্ছে প্রেসভাইটার, সিগনিয়ার, এলডারম্যান ও এলডার। মুরব্বি মহান ব্যক্তি বলে একজন চৈনিক ভিক্ষুক পথিককে সম্বোধন করে। কিন্তু জ্ঞানসমৃদ্ধ যাজক ও সাহিত্যিকদের যৌথ সংস্থা গঠিত হয় জ্ঞানী ব্যক্তিদের ক্ষমতা সংগঠিত হলে। সব জ্ঞান যাদের ভেতর পুঞ্জীভূত আছে বলে মনে হয়। একজন উপাধিপ্রাপ্ত যোদ্ধা থেকে ভিন্ন ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন মহাজ্ঞানী বা পরমজ্ঞানী ব্যক্তি। ভিন্ন ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় তার শাসনের জন্য। এর বিপরীত দৃষ্টান্ত হলো চীন ও জাপান।
যদিও জ্ঞান সভ্যতার ক্ষেত্রে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিকতর ভূমিকা রাখে তারপরও ইতিমধ্যে আমরা এমন অদ্ভুত জ্ঞানের উল্লেখ করেছি যে নতুন জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিদের ক্ষমতা অনুরূপভাবে বৃদ্ধি পায়নি। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন কর্মীরা আমাদের সহায়ক অদ্ভুত কর্ম সম্পাদন করে থাকলেও আমরা কিন্তু তাদেরকে মেডিসিনম্যানের মতো মনে করি না। তাদের বিরক্ত করলে তারা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে পারে, এ কথা আমরা চিন্তা করি না। এর কারণ কঠিন হলেও বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় জ্ঞান দুর্বোধ্য নয়। এ জ্ঞান তাদের জন্য উন্মুক্ত যারা প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে। সুতরাং আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা কোনোরূপ ভীতির সঞ্চার করেন না, শুধু চাকরিজীবী হিসেবেই থাকেন। তবে ব্যতিক্রম দেখা যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ক্যান্টারবারির আর্কবিশপ ব্যর্থ হন তার পূর্বসূরিদের ক্ষমতা অর্জনে সহায়ক মহিনীমায়া অর্জনে।
জ্ঞানী ব্যক্তিদের সম্মান প্রদর্শন করা হয় স্বাভাবিক জ্ঞানের জন্য নয় বরং অনুমিত ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার জন্যে। বিজ্ঞান বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বিনষ্ট করে দিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়ে ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে। বিজ্ঞানীরা আমাদের এ যুগের সঙ্গে আগের যুগের পার্থক্য সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যগুলোর জনক এবং তারা অপরিমেয় প্রভাব রাখেন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনীর মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহের উপর। তা সত্ত্বেও ভারতীয় উলঙ্গ ফকির ও ম্যালেনেশিয়ার মেডিসিনম্যানের মতো তারা জ্ঞানের জন্য এত খ্যাতি অর্জন করতে পারেন না। নিজেদের কার্যকলাপের দরুন বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক বিশ্বের প্রতি বিরাগভাজন হন তাদের মর্যাদা ফসকে যেতে দেখে। কমিউনিজমে বিশ্বাসী হন ন্যূনতম বিরাগভাজন ব্যক্তি; এই অনুভূতি যাদের ভেতর অনেক গভীরে নির্জন আবাসে তারা একান্তে চুপ করে থাকেন।
নতুন এক ধরনের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে বড় বড় অর্থনৈতিক সংগঠনের পরিবৃদ্ধি। তাকে আমেরিকায় বলা হয় নির্বাহী। তিনি অন্য মানুষের প্রভাবিত করেন ত্বরিত উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম লৌহরূপ ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে। তার থাকতে হবে সুদৃঢ় চোয়াল, শক্তভাবে বদ্ধ ঠোঁট এবং সংক্ষিপ্ত ও ধারালো কথা বলার অভ্যাস। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে হবে সমকক্ষ ব্যক্তিদের মনে এবং বিশ্বাসম্প্রবণ করে তুলতে হবে অধীনস্তদের। তাকে অর্জন করতে হবে একজন মহান জেনারেল বা একজন কূটনীতিকের গুণাবলি। তিনি হবেন দ্বন্দ্বে নিষ্ঠুর কিন্তু আলোচনার টেবিলে তিনি হবেন দক্ষ সম্মতি প্রদানকারী। মানুষ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে এসব গুণাবলি দ্বারা।