বিশাল সংখ্যালঘিষ্ট জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সর্মথন লাভের ঐতিহ্যগত ক্ষমতা বিলুপ্ত হলে এর পরিবর্তে বিপ্লবী কর্তৃত্ব স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। এমন হয়েছিল আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে। নগ্ন ক্ষমতার কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে। একইভাবে ক্যাথলিক চার্চের পরিবর্তে নতুন চার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে। বলের চেয়ে সম্মতির উপর অধিক নির্ভরশীল ছিল তাদের সফলতা। নগ্ন ক্ষমতার ব্যাপক ব্যবহার ছাড়া সফল প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবী কর্তৃত্ব তার ঐতিহ্যগত কর্তৃত্বের তুলনায় বীর্যবান হবে আরও অনেক বেশি এবং লাভ করবে সক্রিয় জনসমর্থন। ১৯১১ সালে যখন ঘোষণা করা হয় চীন প্রজাতন্ত্র তখন বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত ব্যক্তিরা রায় দেয় সংসদীয় সংবিধানের পক্ষে। কিন্তু জনগণ ছিল উদাসীন এবং সরকার শিগগিরই পর্যবসিত হয় যুদ্ধবাজ টিউকানস (সামরিক সরকার)-এর অধীন নগ্ন ক্ষমতায়। পরবর্তী সময়ে কমিনটার্ন কর্তৃক অর্জিত এ ধরনের একতা নির্ভরশীল ছিল জাতীয়তাবোধের উপর, সংসদীয় ব্যবস্থার উপর নয়। একই ধরনের বিষয় প্রায়ই ল্যাটিন আমেরিকাতে ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে জনপ্রিয় সমর্থন পেলে সংসদীয় কর্তৃত্ব যথেষ্ট বিপ্লবী হয়ে যেত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খাঁটি সামরিক ক্ষমতা ছিল বিজয়ী এবং তা ছিল নগ্ন।
ঐতিহ্যগত, বিপ্লবী এবং নগ্ন ক্ষমতার ভেতর পার্থক্য মনস্তাত্ত্বিক শুধু প্রাচীনত্ব থাকলেই কোনো ক্ষমতা ঐতিহ্যগত হবে আমি এমন মনে করি না; এর প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। আংশিকভাবে প্রথার জন্য এই শ্রদ্ধাবোদ হয়ে থাকে। ঐতিহ্যগত ক্ষমতা নগ্ন ক্ষমতায় রূপান্ততির হয় এই শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেলে। ১৯১৭ সালের বিজয় মুহূর্ত পর্যন্ত রাশিয়াতে এই রূপান্তর পদ্ধতি দেখা দেয় ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে।
আমি বিপ্লবী ক্ষমতা বলি নতুন ধর্মমত, কর্মসূচি, ভাবাবেগ এবং জাতীয় স্বাধীনতার আশাবাদকে কেন্দ্র করে একতাবদ্ধ বিশাল জনগোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল ক্ষমতাকে। আমি নগ্ন ক্ষমতা তাকে বলি যে ক্ষমতা ব্যক্তি বিশেষের ক্ষমতালিপ্সা থেকে উদ্ভুত সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া শুধু ভয়ের মাধ্যমে প্রজাসাধারণের বশ্যতা অর্জন করে। নগ্ন ক্ষমতা মাত্রাগত ব্যাপার। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাপেক্ষে সরকারের ক্ষমতা নগ্ন নয়। কিন্তু তা নগ্ন নৈরাজ্যবাদীদের সাপেক্ষে। একইভাবে যেখানে চার্চের ক্ষমতা বিরুদ্ধবাদীদের সাপেক্ষে নগ্ন সেখানে নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান-গোঁড়া পাপীদের সাপেক্ষে নয়।
আমাদের আলোচ্য বিষয়ের অন্য দিক হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতার ভেতর বিভক্তি। কোনো প্রতিষ্ঠান যে পন্থায় ক্ষমতা দখল করে তা কিন্তু এক, অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি যে পন্থায় সংগঠনের ভেতর ক্ষমতা দখল করে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অবশ্য এ দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে আপনাকে অবশ্যই দলের ভেতর ক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং দেশের ভেতর আপনার দল ক্ষমতা অর্জন করবে। কিন্তু কোনো জাতীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্য উত্তরাধিকার নীতি প্রচলিত থাকলে আপনাকে রাজার উত্তরাধিকারী হতে হবে। আপনি অন্য দেশ জয় করতে সমর্থন হবেন না এই উত্তরাধিকার লাভ করে। আপনাকে বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত হতে হবে ভিন্ন দেশ জয়ের জন্য। অবশ্যই প্রায়ই এ গুণগুলোর অভাব দেখা যেত রাজপুত্রদের মধ্যে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ জাতীয় অবস্থা বর্তমান যুগে বিরাজ করছে যেখানে ধনতন্ত্র প্রধানত উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ধরা যাক ফ্রান্সে দুইশ ধনী পরিবার রয়েছে যাদের টী ব্যবস্থাপনায় আগের মতো নেই; কারণ তারা ব্যর্থ হয়েছে ব্যাপকভাবে স্বর্গীয় অধিকারের মতবাদ গ্রহণ করতে। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ছাড়া উঠতি ধনী ব্যক্তি তার ভাইকে দরিদ্রে পরিণত করলে কেউ তা অধর্ম মনে করে না।
নানা ধরনের সংগঠন নানা রকম ব্যক্তিকে শীর্ষে উঠিয়ে দেয়। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির উন্নতির সহায়ক সমাজের বিভিন্ন রকম অবস্থাও। ইতিহাসে এক একটি যুগের সূচনা করে বিখ্যাত ব্যক্তির কার্যকলাপ এবং এর আপাত বৈশিষ্ট্য উদ্ভূত হয় এসব ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য থেকেই। পরিবর্তিত হয় খ্যাতিলাভের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাগুণ। অনুরুপভাবে পরিবর্তন ঘটে খ্যাতিমান ব্যক্তিদেরও। অনুমান করা যায়, লেলিনের মতো ব্যক্তিত্ব ছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে এবং বর্তমান সমাজে রয়েছে রিচার্ড কয়ার ডি লায়নের মতো ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তারা অজ্ঞাত ইতিহাসে। এক মুহূর্তের জন্য আসুন আমরা ভাবি কোন ধরনের মানুষ কোন ধরনের ক্ষমতার ফসল।
ভদ্রলোক সম্বন্ধে আমাদের ধারণার জন্ম দিয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতা। এটি আমাদের ধারণার কিছু অধঃপতিত রূপ। এর রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস-গোত্রপতিদের ঐন্দ্রজালিক বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে রাজার দেবত্ব, পীরের পীরত্ব, বিজয় ও আভিজাত্য পর্যন্ত। উত্তরাধিকার আইন যে দেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বলবৎ রয়েছে সেখানে প্রশংসতি বৈশিষ্ট্যগুলোর উৎস অবসর ও প্রশ্নাতীত শ্রেষ্ঠত্ব। নিম্নশ্রেণিভুক্ত সমাজে ক্ষমতা রাজতান্ত্রিক না হয়ে অভিজাততান্ত্রিক হলে সবিনয় আত্মপ্রকাশসহ সমপর্যায়ভুক্ত লোকের সঙ্গে ভদ্রতা অন্তর্ভুক্ত হয় সর্বোৎকৃষ্ট আচরণে। আচরণের ব্যাপক ধারণা থাকা সত্ত্বেও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতার অধীন এলাকার মানুষের গুণাগুণ তার আচরণ দ্বারা বিচার্য। সামাজিক সক্ষমতা অনুশীলনের চেয়ে ভালো কিছু সম্পাদনে অনভ্যস্ত নারী-পুরুষ সমন্বয়ে গঠিত বুর্জোয়া জেন্টিলহোম অনুপ্রবেশ করলে হাস্যাস্পদ হয়ে থাকে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সমাজের উপর নির্ভরশীল ভদ্রলোকের প্রশংসায় বিদ্যমান বিষয়গুলো এবং তা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায় পিতা থেকে পুত্রের হাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরিত না হলে।