চীনের চিরাচরিত শিক্ষাপদ্ধতি কোনো কোনো বিষয়ে এথেন্সের গৌরবময় যুগের শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূর্ণ অনুরূপ। এথেন্সবাসী বালকদিগকে হোমারের কবিতা প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করিতে হইত। চীনা বালকদিগকে দেবদেবিকে শ্রদ্ধা করিতে শিখিত। এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন কতকগুলি আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিত, তাহাদের বুদ্ধিমূলক উচ্চ-চিন্তায় কোনো প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিত না। ঠিক এমনিভাবে চীনারা তাহাদের পূর্বপুরুষের পূজা [Ancestor-worship] সংক্রান্ত কতকগুলি রীতিনীতি শিক্ষা করিত; কিন্তু শিক্ষিত বয়স্ক যে ইহা বিশ্বাস করিবে এরূপ আশা করা হইত না : যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করা চলিতে পারে কিন্তু কোনো স্থির নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া হীন কাজ বলিয়াই বিবেচনা করা হইত। অভিমত বা মতবাদ এমন হওয়া চাই যেন তাহা লইয়া ভোজের আসরে মনোজ্ঞ আলোচনা করা চলে, যেরূপ মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষ যুদ্ধ করতে কুণ্ঠিত হয় না সেরূপ হওয়ার দরকার নাই। কার্লাইল [Carlyle] প্লেটোকে বলিয়াছেন তিনি জিয়নে আরামে বিরামে আসীন একজন সম্ভ্রান্ত এথেনীয়ন ভদ্রলোক। এই আরাম এবং বিলাসের মধ্যে আসীন থাকার বৈশিষ্ট্য চীন ঋষিদের মধ্যেও বিদ্যমান কিন্তু খ্রিস্টান জ্ঞানীদের মধ্যে এই ভাব দেখা যায় না। অবশ্য গেটের মতো গ্রিক সভ্যতা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত লোকদের মধ্যে ইহার ব্যতিক্রম হইয়াছে। এথেন্সবাসী এবং চীনাদেশবাসী উভয়েই জীবনকে উপভোগ করিতে চাহিয়াছিল; তাহাদের জীবনে উপভোগের ধারণা শোভন সৌন্দর্যবোধ দ্বারা মণ্ডিত হইয়াছিল।
এই দুইটি সভ্যতার মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। তাহার প্রধান কারণ-গ্রিকরা উদ্যমশীল এবং সকল কাজে উৎসাহী আর চীনারা অলস। গ্রিকরা তাহাদের শক্তি, শিল্প, বিজ্ঞান এবং আত্মধ্বংসী কলহে নিয়োজিত করিয়াছিল। এ সকল ক্ষেত্রেই তাহারা অপূর্ব সাফল্য লাভ করিয়াছিল। রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম অবলম্বন করিয়া গ্রিকদের শৌর্য আত্মপ্রকাশ করিত : স্বদেশ হইতে বিতাড়িত হইলে রাজনৈতিক নেতারা নির্বাসিত লোকদের লইয়া দল গঠন করিয়া নিজেদের দেশ আক্রমণ করিত। চীনা কর্মচারী কর্মচ্যুত হইলে পাহাড় অঞ্চলে নির্জনবাস করিতে যাইত এবং পল্লীর সুখসৌন্দর্য সম্বন্ধে কবিতা লিখিত। এইভাবে গ্রিক সভ্যতা আত্মঘাতী হইয়াছিল, কিন্তু চীনা সভ্যতা কেবল বাহিরের শত্রু কর্তৃকই ধ্বংস হইতে পারে। অবশ্য এই পার্থক্যের জন্য, কেবল শিক্ষাকেই দায়ী করা চলে না; কেননা কনফুসিয়াসের মতবাদ জাপানে প্রবর্তিত হইলেও সেখানে শুধু কিয়াটোদের অভিজাত সম্প্রদায় ছাড়া অন্যদের মধ্যে চীনাদের মতো শিক্ষিত, সভ্য এবং অলস তার্কিকদল সৃষ্টি করে নাই।
চীনা শিক্ষার ফল হইয়াছে পরিবর্তনবিমুখতা [Stadility] এবং শিল্পের প্রসার। ইহা প্রগতি কিংবা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সুফল প্রদান করে নাই। অলস তার্কিকতা যেখানে প্রাধান্য লাভ করে সেখানে ফলাফল বোধহয় এইরূপই হইয়া থাকে। দৃঢ় জীবন্ত বিশ্বাস উন্নতির পথে লইয়া যায়, আর না হয় বিপদ টানিয়া আনে, অচলায়তনের মধ্যে জাতিকে বদ্ধ রাখে না। মানুষের বিশ্বাস যেখানে শিথিল সেখানে বিজ্ঞান প্রসার লাভ করিতে পারে না, কারণ বিজ্ঞান প্রচলিত কুসংস্কারের মূলে আঘাত করে বটে কিন্তু ইহার উপরও তো দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস রাখা চাই! আধুনিক বিজ্ঞান পৃথিবীর দেশগুলিকে পরস্পরের সংস্পর্শে আনিয়াছে; যুদ্ধসঙ্কুল বিশ্বের জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শক্তি ও শৌর্যের প্রয়োজন আছে; এবং বিজ্ঞান ছাড়া গণতন্ত্র অসম্ভব। চীন সভ্যতা অল্পসংখ্যক শিক্ষিত লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; গ্রিক সভ্যতা দাস প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এইজন্য, চীনদেশের চিরাচরিত শিক্ষা বর্তমান যুগের উপযোগী নয় বলিয়া চীনগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াছে। এই একই কারণে অষ্টাদশ শতাব্দীর চীনা সংস্কৃতিবান অভিজাতগণও অপ্রয়োজনীয় হইয়া পড়িয়াছেন।
বিশ্বের সকল বৃহৎ শক্তির মধ্যে যে-ভাবের প্রাধান্য দেখা যায় আধুনিক জাপানে তাহার সুস্পষ্ট উদাহরণ মিলিবে। এভাবে হইল জাতীয় উন্নতিকে শিক্ষার সর্বপ্রধান লক্ষ্য বলিয়া গ্রহণ করা। জাপানি শিক্ষার উদ্দেশ্য হইল অধিবাসীদের প্রবৃত্তিগুলিকে যথাযথভাবে ট্রেনিং দিয়া রাষ্ট্রের প্রতি অনুরক্ত নাগরিক তৈয়ার করা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে লাগে এমন জ্ঞান দান করা। যেরূপ কৌশলে এই দুইটি উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা হইয়াছে তাহার প্রশংসা করিয়া শেষ করা যায় না। কমোডোর পেরি যখন যুদ্ধজাহাজ লইয়া জাপানের উপকূলে উপনীত হইয়াছিলেন তখন হইতে জাপানে আত্মরক্ষার সমস্যাটি বড় এবং কঠিন হইয়া রহিয়াছে। এ বিষয়ে জাপানিদের সাফল্য তাহাদের শিক্ষাব্যবস্থারই সাফল্য প্রমাণ করে; নতুবা আত্মরক্ষাকে অপরাধ বলিয়া গণ্য করিতে হয়। জাতি যেখানে আসন্ন বিপদের সম্মুখিন, সেখানেই কেবল এইরূপ শিক্ষাব্যবস্থা সমর্থন করা যায়, অন্যত্র ইহা অচল। শিন্টো ধর্ম এমনভাবে রক্ষিত যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পর্যন্ত ইহার সমালোচনা করার বা প্রশ্ন করার অধিকার নাই; ইহার ইতিহাস বাইবেলের জেনেসিস [Genesis] অধ্যায়ের মতোই সংশয়জনক। জাপানে ধর্মের নামে যে অত্যাচার হইয়াছে তাহার পাশে ডেটন [Day ton]-এর বিচার ম্লান হইয়া পড়ে। সেখানে নীতিগত অত্যাচারও চলিয়াছে অনুরূপভাবে। জাতীয়তা, সন্তানবাৎসল্য, মিকোডো পূজা প্রভৃতি সম্বন্ধে কাহারও কোনোরূপ বিরূপ সমালোচনা করার উপায় নাই। কাজেই নানা বিষয়ে উন্নতির পথও রুদ্ধ। এইরূপ লৌহঘঁচে-ঢালা ব্যবস্থার বিপদ এই যে উন্নতির পন্থা হিসাবে ইহা বিপ্লব জাগাইয়া তোলে। ইহাই সত্যিকারের বিপদ এবং দ্রত না হইলেও শিক্ষাব্যবস্থাই ইহা ঘটায়।