বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের প্রকৃত প্রণালী এইরূপ হওয়া উচিত; শিক্ষা বৎসরের প্রারম্ভে শিক্ষক কতকগুলি বই-এর তালিকা দিবেন যেগুলি ছাত্রদিগকে যত্নের সঙ্গে অধ্যয়ন করিতে হইবে, আর কতকগুলি বইয়ের নাম দিবেন যেগুলি সকলে না পড়িলেও কতক ছাত্র পড়িতে পারে। তিনি এমন কতকগুলি প্রশ্ন জানাইয়া দিবেন যাহা ভালভাবে উত্তর করিতে হইলে বুদ্ধি খাটাইয়া উল্লিখিত বইগুলি হইতে বিষয়বস্তু সংগ্রহ করিতে হইবে। ছাত্রগণ স্বচেষ্টায় অধ্যয়নের ফলে প্রশ্নের উত্তর তৈয়ার করিলে শিক্ষক একে একে প্রত্যেকের উত্তর দেখিবেন। যে সফল ছাত্র তাহার সঙ্গে পাঠ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে চাহে সপ্তাহে একদিন কিংবা একপক্ষকালে একদিন সন্ধ্যায় তিনি তাহাদিগকে আলোচনার সুযোগ দিবেন। প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রায় এই ধরনের ব্যবস্থাই আছে। শিক্ষকের নির্দিষ্ট প্রশ্নের পরিবর্তে যদি কোনো ছাত্র নিজেই প্রশ্ন বাছিয়া লয় তাহাতে আপত্তি করিবার কোনো কারণ নাই। এই কাজে তাহার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে তবে দেখিতে হইবে তাহার স্বয়ং নির্বাচিত প্রশ্ন শিক্ষক নির্ধারিত প্রশ্নের সমান কঠিন হওয়া চাই। ছাত্রের লিখিত উত্তরপত্র পরীক্ষা করিলেই তাহার অধ্যবসায় কতখানি তাহা বোঝা যাইবে।
একটি বিষয়ের উপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে গবেষণাকার্যে নিযুক্ত থাকিতে হইবে। তাহার অধ্যাপনার বিষয়ে অন্যান্য সকল দেশে কি কি গবেষণা হইতেছে এবং কোথাও কোনো নূতন তথ্য বা জ্ঞাতব্য বিষয়ের উপর নূতন আলোকপাত হইতেছে কিনা তাহা অধ্যয়ন করিবার যথেষ্ট অবসর তাহার থাকা চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কৌশল একান্ত প্রয়োজনীয় নয়; যিনি যে বিষয় পড়ান সে সম্বন্ধে তাঁহার জ্ঞানের গভীরতা এবং তৎসংক্রান্ত আধুনিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় থাকা চাই। যিনি অত্যধিক কাজের চাপে পরিশ্রান্ত এইরূপ লোকের পক্ষে ইহা সম্ভবপর নহে। এইরূপ ক্ষেত্রে তাঁহার অধ্যাপনার বিষয় তাহার নিকট নীরস হইয়া দাঁড়ায় এবং যৌবনে তিনি যাহা শিখিয়াছিলেন তাহাই হয় তাহার শিক্ষাদান কার্যে একমাত্র মূলধন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষকের পক্ষে প্রতি সাত বৎসরে এক বৎসরকাল সময় বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা অন্য কোনো দেশে জ্ঞানার্জনের জন্য কাটানো উচিত। আমেরিকায় এইরূপ ব্যবস্থা আছে কিন্তু ইউরোপীয় দেশসমূহের বিদ্যার অহমিকা এতই বেশি যে, এইরূপ প্রয়োজনীয় তাঁহারা স্বীকার করিতে চান না। এই বিষয়ে তাঁহারা ভ্রান্ত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যাহাদের নিকট গণিতশাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছিলাম তাঁহারা ইউরোপের অন্যান্য দেশে পূর্ববর্তী কুড়ি হইতে ত্রিশ বৎসর গণিতবিদ্যায় যে অগ্রগতি হইয়াছিল সেই সম্বন্ধে কোনো খোঁজখবর রাখিতেন না–আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রাবস্থায় আমি ভিয়ারস্রাসের নাম কখনো শুনি নাই। পরে ইউরোপ ভ্রমণের সময় আমি আধুনিক গণিতের সংস্পর্শে আসি। এইরূপ ঘটনা কেবল একক বা একান্ত বিরল ছিল না, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই প্রযোজ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে কিছুটা মতানৈক্য আছে : একদল শিক্ষাদানের উপর জোর দেন, অন্য দল গবেষণা কার্যকেই প্রধান মনে করেন। ইহার প্রধান কারণ শিক্ষাদান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ছাত্রের প্রবেশ যাহাদের মানসিক ও বুদ্ধিগত শক্তি এবং অধ্যবসায়ের পরিমাণ উচ্চতর শিক্ষার উপযুক্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুলের মতো শিক্ষাদানের রীতি এখনও কিছুটা রহিয়াছে। ছাত্রদের নিকট বক্তৃতা করিয়া, স্কুলের ছাত্রদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদিগকেও পাঠ অনুশীলনে বাধ্য করিয়া সুফল লাভের চেষ্টা করা হয়। ছাত্রদিগকে কাজের জন্য মৌখিক উপদেশ ও উৎসাহ দিয়া কোনো লাভ নাই; আলস্যবশত অথবা সামর্থ্যের অভাবে যে কোনো কারণেই হোক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নের যোগ্যতার পরিচয় দিতে না পারিলে তাহাকে সেখান হইতে বিদায় দিতে হইবে, কারণ এইরূপ ছাত্র অন্যত্র কোনো কাজে নিযুক্ত থাকিলে বরং সময়ের ও অর্থের বৃথা অপচয় হইবে না। শিক্ষকের বহু ঘণ্টা ধরিয়া অধ্যাপনা করিবার প্রয়োজন নাই; জ্ঞানার্জন সাধনায় তাহাকে অবসর সময়ে ব্যাপৃত থাকিতে হইবে।
মানব-জাতির জীবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কাজ তাহা বিবেচনা করিলে দেখা যাইবে গবেষণা শিক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। নূতন জ্ঞান অবলম্বন করিয়াই ক্রমোন্নতির ধারা চলিয়াছে; ইহার অভাবে বিশ্বের (উন্নতির গতি) প্রগতি থামিয়া যাইবে। বর্তমান সময় পর্যন্ত যে জ্ঞান মানুষের অধিগত হইয়াছে তাহার প্রসার ও ব্যাপক প্রয়োগের ফলে আরও কিছুকাল উন্নতির ধারা অব্যাহত থাকিবে কিন্তু ইহা খুব বেশিদিন চলিবে না। নিছক প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য যে জ্ঞান তাহাও চিরদিন মানুষের মন অধিকার করিয়া রাখিতে পারে না। বিশ্ব-রহস্যকে ভালভাবে বুঝিবার জন্য যে নিঃস্বার্থ উদ্যম ও গবেষণায় মানুষ প্রবৃত্ত হয় তাহা হইতেই প্রয়োজনার্থ জ্ঞান উদ্ভূত হয়। প্রথমে মানুষ বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক [Theoretical] জ্ঞান অর্জন করে পরে তাহাই প্রয়োজনে খাটানো সম্ভবপর হয়, কেননা উচ্চস্তরের তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রয়োজনে লাগানো সম্ভবপর না হইলেও ইহার নিজস্ব মূল্য আছে কেননা বিশ্বের রহস্য সম্বন্ধে ও বৈজ্ঞানিক সংস্থা যদি মানুষের দেহের প্রয়োজন মিটাইতে এবং যুদ্ধ ও নিষ্ঠুরতা দূর করিতে পারে তবে জ্ঞান ও সৌন্দর্যের সাধনা আমাদের মনে সৃষ্টির প্রেরণা যোগাইতে থাকিবে। কবি, চিত্রশিল্পী, সাহিত্যিক অথবা গণিতবিদ নিজেদের সৃষ্টিকে কেবল মানুষের প্রয়োজনে লাগাইতে ব্যস্ত থাকুন ইহা আমার কাম্য নয়। ভাবজগতে বিচরণ করিতে স্রষ্টার মানস-গগনে যে নূতন জ্ঞানের প্রথম আলোর আভাস ক্ষীণ আভায় ফুটিয়া ওঠে তাহাকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করিতে এবং নবসৃষ্টিতে রূপায়িত করিতে তাহার যে আনন্দ তাহার সহিত তুলনায় জগতের সকল আনন্দ ম্লান হইয়া যায়। জগতে শিল্প ও বিজ্ঞানের যত কিছু উন্নতি, তাহার মূলে আছে দুর্লভকে লাভ করার অদম্য বাসনা। যাহা প্রথমে মনে হয় অবাস্তব কল্পনা তাহাই বৈজ্ঞানিক সাধনায় বাস্তবে পরিণত হয়; যেইরূপকল্পনা শিল্পীর ভাবনেত্রে প্রথমে অস্পষ্ট কমনীয় আভাস ফুটিয়া ওঠে তাহাই পরে রেখায়, রঙে, সাহিত্যে, শিল্পে মাধুর্যমণ্ডিত হইয়া উপভোগ্য হইয়া ওঠে। দুর্লভকে লাভ করার সাধনায় মানুষ অকুণ্ঠিতচিত্তে বিপদের মুখে আগাইয়া যায়, সকল রকম কৃচ্ছসাধন স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া লয়। যে-সকল ব্যক্তির এইরূপ গভীর অনুরাগ ও মানসিক সামর্থ্য থাকে তাহাদিগকে প্রয়োজনার্থক কাজের শিকলে বাঁধিয়া রাখিয়া তাহাদের প্রতিভা স্ফুরণে বাধা দেওয়া উচিত নয়। কেননা যাহা কিছু মানুষকে মহান করিয়াছে তাহা সবই এই জাতীয় লোকের প্রচেষ্টা হইতে উদ্ভূত।
১৭. উপসংহার
আমাদের ভ্রমণ শেষে পিছন দিকে তাকাইয়া বিহগ-দৃষ্টিতে আলোচিত বিষয়গুলির উপর এক চোখ বুলাইয়া লই।