বর্তমানে ধনীলোকের সন্তান না হইলে আইন বা চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করা ছাত্রদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন, কেননা এই শিক্ষা ব্যয়বহুল। তাহা ছাড়া শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পরই অর্থোপার্জন শুরু হয় না। কাজেই দেখা যায় এই ব্যক্তিগুলির জন্য নির্বাচন হয় ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকের সামাজিক ও আর্থিক প্রতিপত্তি দ্বারা, ছাত্রদের কাজের যোগ্যতা ও গুণপনার দ্বারা নয়। উদাহরণ স্বরূপ চিকিৎসাবিদ্যার শিখাইয়া সমাজসেবার কাজে নিয়োগ করিতে হয় তবে যাহাদের এ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা বেশি আগ্রহ, আন্তরিকতা ও প্রবণতা আছে এমন ব্যক্তিদিগকে নির্বাচন করা উচিত। বর্তমানে যাহারা খরচ বহন করিতে সমর্থ কেবল এমন প্রার্থীদের মধ্য হইতেই লোক বাছাই করিতে হয় কিন্তু এমনও হইতে পারে যে, যাহারা চিকিৎসাবিদ্যায় সর্বাপেক্ষা পারদর্শিতা দেখাইতে পারিত এমন লোক অর্থাভাবে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করার সুযোগই পাইল না। ইহার ফলে প্রতিভার অপচয় ঘটে। অন্য রকম একটি উদাহরণ লওয়া যাক। ইংল্যান্ড অত্যন্ত জনবহুল দেশ; ইহার বেশিরভাগ খাদ্যই বিদেশ হইতে আমদানি করিতে হয়। কতকগুলো বিষয় বিবেচনা করিতে বিশেষত যুদ্ধের সময় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করিলে বোঝা যায়। এই দেশে খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত আবশ্যক। এখানকার চাষযোগ্য জমির পরিমাণ অত্যন্ত কম; তথাপি এইগুলি যথাসম্ভব উন্নত প্রণালীতে সুযোগ্যভাবে চাষ করার ব্যবস্থা হয় নাই। বংশানুক্রমিকভাবেই কৃষকগণ এই পেশা গ্রহণ করে; সাধারণত তাহারা কৃষকদেরই পুত্র। আর কতক কৃষিক্ষেত্র কিনিয়াছে; ইহার জন্য তাহারা টাকা খরচ করিয়াছে তাই বলিয়া কৃষিকার্যের যোগ্য নিপুণতা অর্জন করিয়াছে এমন কথা নাই। ডেনমার্কের কৃষকদের চাষের প্রণালী ইংল্যান্ডের চাষিদের তুলনায় বেশি ফলপ্রদ। কিন্তু ইংল্যান্ডের কৃষকদের তাহা শিকাইবার কোনো ব্যবস্থাই অবলম্বন করা হয় না। একজন মোটরচালককে যেমন লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র লইতে হয় তেমনই যে কৃষকই কিছু বেশি পরিমাণ জমি চাষ করিবে তাহাকেই বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে চাষ সম্বন্ধে শিক্ষা গ্রহণ করিতে বাধ্য করা উচিত। সরকারি কাজকর্মে বংশানুক্রমিক নিয়োগপ্রথা পরিত্যক্ত হইয়াছে কিন্তু জীবনের কোনও ক্ষেত্রে এখনও ইহা চলিতেছে। যথায় ইহা আছে তথায় অযোগ্যতা প্রবেশ করিয়াছে। দুইটি সংশোধন নিয়ম দ্বারা এই অযোগ্যতা দূর করা উচিত; প্রথমত, উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত কাহাকেও কোনো প্রয়োজনীয় কাজে নিযুক্ত হইতে দেওয়া উচিত নয়; দ্বিতীয়ত, যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের অভিবাবক অর্থশালী হউক বা না হউক অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার ব্যয় বহনে তাহাদের সামর্থ্য থাকুক আর নাই থাকুক তাহা বিবেচনা না করিয়া তাহাদের শক্তি ও প্রতিভা বিকাশের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। এই দুইটি নিয়ম পালন করিলে লোকের ব্যক্তিগত যোগ্যতা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাইবে।
যাহাদের বিশেষ কোনো শক্তি বা গুণ আছে তাহা পরিপূর্ণমাত্রায় বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা উচিত। যাহাদের যোগ্যতা আছে কিন্তু শিক্ষার ব্যয়নির্বাহের যোগ্য অর্থ নাই, রাষ্ট্রকর্তৃক তাহাদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা উচিত। যোগ্যতার প্রমাণ দিতে না পারিলে কাহাকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি করা সমীচীন নয় এবং ভর্তি হওয়ার পরও কেহ যদি প্রমাণ দিতে না পারে যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করিতেছে তবে তাহাকেও থাকিতে দেওয়া উচিত নয়। পূর্বে ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ধনীর দুলালদের আরাম-নিকেতন, তাহারা তথায় তিন-চারি বৎসর আলস্যে ও বিলাসে কাটাইতে পারে, এই ধারণা এখন লোপ পাইতেছে।
যখন বলি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত যুবক-যুবতীদিগকে আলস্যে সময় কাটাইতে দেওয়া উচিত নয়। তখন ইহাও আমি বলিতে চাই যে, কতকগুলি বাঁধাধরা নিয়ম মানিয়া চলাই কাজের প্রকৃত প্রমাণ নয়। ইংল্যান্ডে নূতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অসংখ্য বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয় এবং তাহাদের ছাত্রদিগকে হাজিরা দেওয়ানোর জোঁক দেখা যায়। মন্তেসরি বিদ্যালয়ে শিশুদের ব্যক্তিগত কাজের স্বপক্ষে যে যুক্তি প্রয়োগ করা হয়, কুড়ি বৎসর বয়সের যুবকদের ক্ষেত্রে–বিশেষত যখন তাহাদের বুদ্ধি ও উদ্যম সাধারণ ছাত্রদের তুলনায় বেশি বলিয়া ধরিয়া লই, তাহাদিগকে ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ কাজে আত্মনিয়োগ করানোর যুক্তি আরও প্রবল। আমি যখন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছিলাম তখন আমার এবং আমার অধিকাংশ বন্ধুর ধারণা হইয়াছিল যেই বক্তৃতা দ্বারা কেবল সময়ের অপচয় করা হইত। আমাদের অবিমত অতিরঞ্জিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই কিন্তু খুব বেশি নয়। বক্তৃতার ব্যবস্থা করার আসল কারণ এই যে, দৃশ্যত ইহাকে কাজ বলিয়া মনে হয়, কাজেই ব্যবসায়িকগণ ইহার জন্য ব্যয় করিতে রাজি হইবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যদি সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করেন ব্যবসায়ীরা তাঁহাদিগকে অলস মনে করিবে এবং শিক্ষকের সংখ্যা কমাইয়া দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে থাকিবে। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাহাদের প্রতিপত্তির বলেই কিছু পরিমাণে উপযুক্ত প্রণালী অবলম্বন করিতে পারেন কিন্তু নূতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারেন না; আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থাও এইরূপ।