এই প্রসঙ্গ আমাদিগকে মনঃসমীক্ষার ক্ষেত্রে লইয়া আসে। মনঃসমীক্ষার মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে যাহা অযৌক্তিক এবং প্রমাণসহ নয়। কিন্তু ইহার সাধারণ প্রণালী আমার নিকট বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে হয়। নৈতিক শিক্ষার সঠিক পদ্ধতি রচনায় ইহা একান্ত আবশ্যক। অনেক মনঃসমীক্ষক শৈশবের প্রথম অবস্থার উপর যতখানি গুরুত্ব আরোপ করেন তাহা আমার নিকট অতিরিক্ত বলিয়া মনে হয়; তাহার অনেক সময়ে বলেন শিশুর বয়স তিন বৎসর হইতে হইতেই তাহার চরিত্র কেমন হইবে তাহা পাকাপাকিভাবে স্থির হইয়া যায়। আমার বিশ্বাস এরূপ কখনও হইতে পারে না। তবে মনঃসমীক্ষকের অভিমতের এই যে মাত্রাধিক্য তাহা ভুল হইলেও যাহা সত্য তাহার দিকেই। অতীতে মনোবিজ্ঞান উপেক্ষিত হইয়াছিল; কার্যত বুদ্ধিবৃত্তি প্রধান [Intellectualist] যে প্রণালী তৎকার্যে প্রচলিত ছিল তাহার কল্যাণে ইহার প্রসার সম্ভবও ছিল না। ঘুমের কথাটি ধরা যাক। সকল মাতাই চান তাহাদের শিশুরা ঘুমাইয়া থাকুক কারণ ইহা তাহাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী এবং মেয়েদের পক্ষেও সুবিধাজনক। ইহার জন্য তাঁহারা এক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করিয়াছিলেন–দোলনায় দোল দেওয়া এবং ঘুমপাড়ানি গান গাওয়া। পুরুষেরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করিয়া আবিষ্কার করিয়াছেন যে, এই প্রণালী আদর্শের দিক দিয়া অপকারী; কারণ কোনো একদিন ইহার ফল পাওয়া গেলেও ইহা খারাপ অভ্যাস গঠন করে। প্রত্যেক শিশুই চায় তাহাকে সবাই খুব সমাদর করুক, কারণ ইহা দ্বারা তাহার অহমিকার ভাব তৃপ্ত হয়। যদি সে বুঝিতে পারে যে, না ঘুমাইলেই সে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তখন সে এই পন্থাই অবলম্বন করিবে। ইহার ফলে তাহার স্বাস্থ্য ও চরিত্রের পক্ষে হানিকর হইবে। এখানে প্রধান বিষয় হইল অভ্যাস গঠন–বিছানার সঙ্গে ঘুমের সহযোগ [Association] স্থাপন। এই সহযোগ যথার্থভাবে স্থাপিত হইলে রুগ্ন কিংবা যন্ত্রণাবোধ করিতে না থাকিলে শিশু জাগিয়া থাকিবে না। কিন্তু এই সহযোগ স্থাপন করিতে হইলে কিছু শৃঙ্খলাবিধানের প্রয়োজন; কেবল আদর দিয়া ইহা গড়িয়া তোলা যাইবে না; কেননা তাহা জাগিয়া থাকিতেই উৎসাহ দেয়। অন্য ভাল এবং মন্দ অভ্যাস গঠনের ব্যাপারেও এই বিষয়ে বিবেচনা করিতে হইবে। মনোবিজ্ঞানের এই দিকটির এখনও শৈশব অবস্থা কিন্তু ইহার গুরুত্ব ইতোমধ্যে যথেষ্ট বাড়িয়াছে এবং আরও সঙ্গেই আরম্ভ হইবে; ধাত্রী এবং অজ্ঞ জননীদের অনেক কার্যকলাপ এবং অভ্যাসের পরিবর্তন আবশ্যক। ইহাও স্পষ্ট যে, পূর্বে যে-সময়ে শিক্ষাদানের উপযুক্ত কাল বিবেচিত হইত, তাহা অপেক্ষা আগেই শিক্ষা আরম্ভ করা চলে; কারণ এই শিক্ষা আনন্দপ্রদ হইলে শিশুকে মনোযোগ-শক্তির উপর জুলুম করিতে হইবে না। এই বিষয়ে আধুনিক যুগে শিক্ষাতত্ত্বে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে, ইহার যে সুফল পাওয়া গিয়াছে তাহা দিন-দিন বাড়িয়াই চলিবে। কাজেই পরের অধ্যায়ে শিশুর পরবর্তীকালীন শিক্ষা কিরূপ হইবে তাহা আলোচনা করার পূর্বে বাল্যকালে শিশুর চরিত্র গঠনের শিক্ষা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিব।
০২. শিক্ষার লক্ষ্য
কিভাবে শিক্ষা দেওয়া হইবে তাহা আলোচনা করিবার পূর্বে বরং শিক্ষা হইতে কিরূপ ফল আশা করি সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। ডক্টর আর্নল্ড চাহিয়াছিলেন মনের নম্রতা; অ্যারিস্টটলের মহানুভব মানবের [Mag nanimous man] মধ্যে কিন্তু এ গুণ দেখা যায় না। নিসের আদর্শ আর খ্রিস্টধর্মের আদর্শ এক নয়; ক্যান্টের আদর্শের সঙ্গেও ইহার মিল নাই; খ্রিস্টধর্মের প্রেমধর্মের উপর জোর দিয়াছেন; ক্যান্ট বলেন, যে কাজের মূল উৎস প্রেম তাহা কখনও সাধু কাজ হইতে পারে না। ভালো চরিত্রগঠনে কি কী উপাদান প্রয়োজন সে বিষয়ে একমত হইলেও কোন উপাদান কি পরিমাণে থাকা দরকার সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে। একজন হয়তো সাহসকে প্রাধান্য দিবেন, অন্য একজন জ্ঞানার্জনের উপর জোর দিবেন; অপর কেহ দয়া এবং কেহ বা সত্যবাদিতাকেই প্রধান মনে করিবেন। প্রথম ব্রুটাসের মত কেহ হয়তো পারিবারিক স্নেহ-প্রীতি অপেক্ষা দেশের প্রতি কর্তব্যকেই সর্বপ্রধান কাম্য বলিয়া মনে করিবেন; আবার কেহ হয়তো কনফুসিয়াসের [Confucius] মতো পরিবারের প্রতি স্নেহপ্রীতিকেই সকলের উপর স্থান দিবেন। এই সব পার্থক্যের দরুন শিক্ষার মধ্যেও পার্থক্য ঘটিবে। কোন ধরনের শিক্ষা সর্বোৎকৃষ্ট তাহা স্থির করিবার পূর্বে শিক্ষাদীক্ষা দিয়া আমরা কি রকম মানুষ প্রস্তুত করিতে চাই সে সম্বন্ধে আমাদের ধারণা থাকা একান্ত আবশ্যক।
অবশ্য শিক্ষাবি যেরূপ লোক প্রস্তুত করিতে ইচ্ছা করেন সব সময়েই যে সেরূপ পারেন তাহা নয়। কখনও বা হয়তো আদর্শের বিপরীত লোক প্রস্তুত হয়; যেমন চ্যারিটি স্কুলে [Charity School] বিনয় শিক্ষার ফলে Uriah Heep-এর মতো লোক তৈয়ারি হইয়াছিল। কিন্তু মোটের উপর সক্ষম শিক্ষাবিদগণ তাঁহাদের উদ্দেশ্য সাধনে বহুল পরিমাণে কৃতকার্য হইয়াছে; উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চীনের শিক্ষাবিদগণ, আধুনিক জাপানের শিক্ষাব্রতীবৃন্দ, জেসুইটগণ, ডক্টর আর্নল্ড এবং মার্কিন শিক্ষার পরিচালকগণ। ইহারা সকলেই ইঁহাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করিয়াছেন। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ইহাদের কাম্য লক্ষ্য অপরের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য হইতে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল, তবু ফললাভ করিয়াছেন সকলেই। শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য কি হওয়া উচিত তাহা স্থির করিবার পূর্বে এই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রণালী আলোচনা করিলে আমরা লাভবান হইবে পারিব।