বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ক্রমে মধ্যযুগে যেমন ছিল তেমনই বিভিন্ন বৃত্তির ট্রেনিং স্কুলে পরিণত হইতেছে। ব্যারিস্টার, ধর্মযাজক এবং উপরের স্তরের সিভিল সার্ভিস কর্মচারিগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ করিয়াছে। ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য ব্যবসায়ে টেকনিক্যাল শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মিগণের অনেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করিতেছে। জগৎ যত জটিল এবং শিল্প যতই বিজ্ঞানের প্রভাবাধীন হইতেছে ততই বিভিন্ন বিষয়ের জন্য দক্ষ লোকের প্রয়োজন হইতেছে। জটিল বিষয়ে দক্ষতাসম্পন্ন লোক এখন বিশ্ববিদ্যালয় হইতেই বাহির হইতেছে। প্রাচীনপন্থীরা দুঃখ করেন যে, বিশুদ্ধ জ্ঞানের মন্দির বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বড় টেকনিক্যাল স্কুলে পরিণত হইতে চলিয়াছে। কিন্তু ইহা প্রতিরোধ করার উপায় নাই কারণ ধনতন্ত্রবাদীরা ইহাই চায়। তাহাদের নিকট বিশুদ্ধ জ্ঞান বা কৃষ্টির কোনো মোহ নাই। শিল্পের জন্যই শিল্প-সাধনার মতো অকেজো শিক্ষা ও আভিজাত্যের আদর্শ, ধনতন্ত্রের কাম্য নয়। যথায় এখনও ইহার রেশ রহিয়াছে তথায় বুঝিতে হইবে। রেনেসাঁস যুগের ঐতিহ্য এখনও শেষ হইয়া যায় নাই। এই আদর্শের বিলোপ আমার নিকট শোচনীয় মনে হয়। বিশুদ্ধ জ্ঞান আভিজাত্যের অলংঙ্কারস্বরূপ ছিল কিন্তু আভিজাত্যের অন্যান্য দোষ এত বেশি ছিল যে তাহার তুলনায় গুণ হইয়াছিল অত্যন্ত হালকা। আমরা পছন্দ করি আর নাই করি শিল্পতন্ত্রের হাতে আভিজাত্যের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কাজেই আভিজাত্যের কোনও প্রশংসনীয় গুণ যদি রক্ষা করিতে চাহি তাহা হইলে শক্তিশালী কোনও নূতন ভাবধারার সঙ্গে তাহার সংযোগ সাধন করিতে হইবে। আভিজাত্যের ক্রমবিলীয়মান ঐতিহ্য আঁকড়াইয়া ধরিতে থাকিলে নূতন যুগের ধনতন্ত্রবাদের আক্রমণের হাত হইতে ইহাকে রক্ষা করা যাইবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ শিক্ষার দ্বারা যদি জিয়াইয়া রাখিতে হয় তবে অল্প কয়েকজন ভদ্রলোকের অবসর বিনোদনের আনন্দদায়ক উপাদান হিসাবে না রাখিয়া ইহাকে সাধারণ মানুষের সমাজ-জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করিতে হইবে। উদ্দেশ্য-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা আমাদের নিকট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে হয়। শিক্ষার্থীর জীবনে ইহা হ্রাস না পাইয়া দিন দিন বেশি হউক ইহাই আমি দেখিতে চাই। ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় এইরূপ শিক্ষা যে ক্রমশ বিলোপের দিকে যাইতেছে তাহার প্রধান কারণ অজ্ঞ ক্রোড়পতিদের নিকট হইতে শিক্ষার উন্নতির জন্য মোটা টাকা সাহায্য গ্রহণের অভিলাষ। এই ধনতান্ত্রিক শিল্পপতিগণ কৃষ্টিমূলক শিক্ষার প্রতি আগ্রহশীল নন; অর্থকরী এবং শিল্পের উন্নতিবিধায়ক শিক্ষার প্রতিই যে তাহাদের ঝোঁক থাকিবে তাহা স্বাভাবিক। এইরূপ অবস্থায় প্রতিকার সম্ভবপর। তবে এইজন্য শিক্ষিত গণতন্ত্র গড়িয়া তুলিতে হইবে, তখন শিল্পপতিগণ যে বিদ্যার কদর বুঝিতে পারে না, জনগণই তাহার জন্য অর্থব্যয় করিতে আগ্রহশীল হইবে। ইহা একেবারে অসম্ভব নয়, কিন্তু ইহা সাধন করিতে হইলে আগে সর্বসাধারণের শিক্ষার মান উন্নত হওয়া আবশ্যক। পূর্বে শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তিগণ (জীবিকার জন্য) ধনবান পৃষ্ঠপোষকের সাহায্যের উপর নির্ভর করিতেন। আধুনিক যুগের বিদ্বজ্জন যদি সর্বদা অর্থশালী লোকদের কৃপাপ্রার্থী না হন তবে ভাল হয়। শিক্ষা এবং শিক্ষিত লোক এক বিষয় নয়, তবু শিক্ষা ও শিক্ষিত ব্যক্তিকে একত্রে তালগোল পাকাইয়া ফেলা অসম্ভব নয়। একটি কাল্পনিক উদাহরণ মনে করা যাক একজন শিক্ষিত ব্যক্তি জৈব রসায়নবিদ্যা শিক্ষাদানের পরিবর্তে মদ তৈয়ার করা শিখাইয়া অর্থোপার্জন করিতে পারেন। তিনি অর্থ লাভ করিবেন কিন্তু শিক্ষার অবনতি ঘটিবে। শিক্ষিত ব্যক্তির যদি জ্ঞানের প্রতি প্রকৃত অনুরাগ থাকিত তবে মদ তৈয়ারি শিক্ষার জন্য যদি কেহ অর্থ দান করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করিতেন তিন তাহাতে যোগাদন করিতেন না। তিনি যদি গণতন্ত্রের পক্ষে থাকিতেন তবে গণতন্ত্রই তাহার বিদ্যার যথাযোগ্য সমাদর করিত। এইসব কারণে আমার মনে হয় শিক্ষাবিদগণ যদি ধনী লোকের নিকট অর্থের প্রত্যাশা না করিয়া জনসাধারণের অর্থের উপরই নির্ভরশীল হন তবেই প্রকৃত কল্যাণ হইবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ধনশালী ব্যক্তিদের নিকট হইতে আর্থিক সাহায্য গ্রহণের কুরীতি ইংল্যান্ড অপেক্ষা আমেরিকাতেই বেশি; তবে ইংল্যান্ডেও ইহা আছে এবং ক্রমশ বেশি হইতে পারে।
এইসব রাজনীতির প্রভাব ও কার্যপরম্পরার কথা বাদ দিয়া আমি ধরিয়া লইব যে, বিশ্ববিদ্যালয় দুইটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রহিয়াছে; প্রথম, কতকগুলি বৃত্তি বা পেশার জন্য পুরুষ ও নারীদিগকে শিক্ষা দিয়া প্রস্তুত করা; দ্বিতীয়, আশু কোনো কিছু লাভের সম্ভাবনা সম্মুখে না রাখিও উচ্চস্তরের জ্ঞান অর্জনের ও গবেষণার সুযোগ দান। কাজেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ছাত্রদিগকে দেখিতে চাহি যাহারা এইরূপ বৃত্তি বা পেশার জন্য উচ্চশিক্ষা চাহে এবং যাহাদের এমন বিশেষ যোগ্যতা আছে যাহা দ্বারা তাহারা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করিয়া সমাজকে মূল্যবান কিছু দান করিতে পারে। বিভিন্ন বৃত্তিশিক্ষার জন্য কিরূপ ছাত্রছাত্রী নির্বাচন করা উচিত তাহা এই নীতির দ্বারা নির্ণয় করা গেল না।