বোডিং-স্কুলের স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলি আলোচনা করা হইল তাহার মধ্যে দুইটিই প্রধান এবং অপরিবর্তনীয় একটি স্বপক্ষে, একটি বিপক্ষে। স্বপক্ষে যুক্তি হইল। পল্লির স্বাস্থ্য, ফাঁকা আলোবাতাস, প্রশস্ত জায়গার সুবিধা। বিপক্ষের যুক্তি হইল– পারিবারিক স্নেহপ্রীতি এবং কর্তব্যবোধ শিক্ষার অসুবিধা। যে-সকল পিতামাতা পল্লিতেই বাস করেন তাহাদের পক্ষে বোর্ডিং-স্কুলের স্বপক্ষে অন্য যুক্তি আছে– যেমন, কাছাকাছি কোথাও ভালো দিবা স্কুল না থাকা। বোর্ডিং স্কুলের স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে এমন যুক্তি রহিয়াছে যে, কোনটি শ্ৰেয় তাহা নির্ণয় করা সত্যই কঠিন। পুত্রকন্যাদের স্বাস্থ্য যদি খুব ভালো হয় তবে বোর্ডিং স্কুলে থাকিলে স্বাস্থ্য ভালো থাকিবে এ যুক্তির জোর কমিয়া যায়। আবার ছেলেরা যদি পিতামাতার প্রতি অনুরক্ত হয় তবে বাড়িতে থাকিয়া স্কুল না করিলেই যে তাহারা পিতামাতার প্রতি প্রীতিশূন্য হইয়া পড়িবে এ যুক্তিও দুর্বল হইয়া পড়ে। কেননা ছুটির মধ্যে তাহারা বাড়িতে আসার সুযোগ পাইবে এবং পারিবারিক স্নেহ হইতে বঞ্চিত হইবে না। দীর্ঘ ছুটির মধ্যে বাড়িতে থাকিলে স্নেহের বাড়াবাড়িও বেশি থাকিবে না। অসাধারণ প্রতিভাবান বালকের বোর্ডিং স্কুলে না যাওয়াই ভাল, সে যদি অতিরিক্ত ভাবপ্রবণ হয় তবে তাহাকে স্কুলে না পাঠানোই সমীচীন। অবশ্য ভালো স্কুল খারাপ গৃহ অপেক্ষা শ্রেয় এবং ভালো গৃহ খারাপ স্কুলের তুলনায় বাঞ্ছনীয়। যথায় দুইটিই ভাল তথায় অবস্থা বিবেচনা করিয়া ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত।
ধনশালী অভিভাবকগণ নিজেদের ইচ্ছামত সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারেন; এই পর্যন্ত এইরূপ অভিভাবকের দিক হইতে প্রশ্নটি বিবেচনা করা হইয়াছে। রাজনৈতিক দিক হইতে বিবেচনা করিলে এই প্রসঙ্গে আরও অন্য প্রশ্ন ওঠে। বোর্ডিং-স্কুল পরিচালনার ব্যয়ের কথা আছে, আবার শিশুদিগকে গৃহ হইতে সরাইয়া লইলে বাসগৃহের সমস্যা কতটা সহজ হয় সেই বিষয়ও বিবেচনাযোগ্য। আমার দৃঢ় অভিমত এই যে, খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রকে ব্যতিক্রম স্বরূপ বাদ দিয়া প্রত্যেকের আঠারো বৎসর বয়স পর্যন্ত পুঁথিগত শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, কেবলমাত্র বৃত্তিমূলক শিক্ষা ইহার পরে শুরু করিতে হইবে।
দিবা-স্কুল বোর্ডিং-স্কুলের মধ্যে কোনটি শ্ৰেয় এ প্রশ্নের উত্তরে উভয় পক্ষেই যথেষ্ট বলিবার আছে। তবে টাকার প্রশ্ন বিবেচনা করিলে দিনমজুরদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য দিবা-স্কুল বাঞ্ছনীয় বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে।
১৬. বিশ্ববিদ্যালয়
পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা চরিত্র-গঠনমূলক ও বুদ্ধিমূলক যে শিক্ষার আলোচনা করিয়াছি তাহা সমাজের সকল ছেলেমেয়ের জন্যই উন্মুক্ত থাকিবে; কোনো গুরুতর বিশেষ কারণ না থাকিলেই সে শিক্ষা দিতে হইবে। শিশুর প্রতিভা যদি বিদ্যালয়ের পড়ার দরুন ব্যাহত হয় এবং অন্য ব্যবস্থা করিলে বিকাশ লাভ করে, তবে তাহার জন্য পৃথক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা উচিত। (মোজার্টকে যদি জোর করিয়া বিদ্যালয়ে পাঠ্যবিষয়গুলি পড়িতে বাধ্য করা হইত তবে ইহা বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয় হইত; তাহার সঙ্গীত-প্রতিভা হয়তো সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হইতে পারিত না।) কিন্তু আদর্শ সমাজেও এমন অনেক লোক থাকে যাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ করিবে না। এই বিষয়ে আমার কোনই সন্দেহ নাই যে, পুঁথিগত শিক্ষাকাল একুশ অথবা বাইশ বৎসর বয়স পর্যন্তবর্ধিত করিলে কেবলমাত্র অল্পসংখ্যক লোকই ইহাতে উপকৃত হইবে। যে সব অলস ধনীর দুলাল এখন পুরাতন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তাহারা কতকগুলি কায়দা-কানুন এবং বেহিসেবিরূপে খরচ করার অভ্যাস ছাড়া আর বিশেষ কিছুই শিক্ষালাভ করে না। সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিরূপ ছাত্র নির্বাচন করা উচিত তাহা বিশেষভাবে বিবেচ্য। বর্তমানে দেখা যায়, যাহার টাকা আছে সেই সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার জন্য পাঠায়। পরীক্ষার ফলাফল দেখিয়া স্কলারশিপ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় অবশ্য কতক ভাল ছাত্রও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িবার সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছাত্র নির্বাচন আর্থিক যোগ্যতা দ্বারা হইয়া ছাত্রের মেধা ও বুদ্ধির যোগ্যতা দ্বারাই হওয়া উচিত। আঠারো বৎসরের বালক ও বালিকা যদি বিদ্যালয়ের মোটামুটি ভালো শিক্ষা পাইয়া থাকে তবে সমাজে অনেক কিছু উপকারী কাজ করিতে পারে। তাহাকে আরও তিন-চারি বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে বৃথা নিযুক্ত না রাখিলে এই সময় সে সমাজসেবার কাজে লাগাইতে পারে। কিরূপ ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো উচিত তাহা নির্ধারণ করিবার পূর্বে আমাদের সমাজ-জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য কি তাহা জানা আবশ্যক।
ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি পর্যায়ের ভিতর দিয়া পার হইয়া আসিয়াছে, যদিও তৃতীয় পর্যায় এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়কে সম্পূর্ণরূপে স্থানচ্যুত করিতে পারে নাই। প্রথম অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ধর্মযাজকদের শিক্ষার কলেজ ছিল; মধ্যযুগে উচ্চশিক্ষা কেবল ইহাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রেনেসাঁসের যুগে অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীতে নূতন ভাবপ্রবণের যুগে প্রত্যেক অবস্থাপন্ন পুরুষের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা উচিত এই ভাব ক্রমে প্রসার লাভকরে; পুরুষদের অপেক্ষা স্ত্রীলোকের শিক্ষা কম হওয়াই উচিত তখন এই ধারণা প্রচলিত ছিল। সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও ঊনবিশ শতাব্দী ধরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভদ্রলোকের শিক্ষা চলিতে থাকে; অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এখনও তাহাই চলিতেছে। এই আদর্শ এক যুগে প্রয়োজনে মনে হইয়াছিল কিন্তু এখন ইহা বাতিল হইয়া গিয়াছে। কি কি কারণে এরূপ ঘটিয়াছে প্রথম অধ্যায়ে তাহার আলোচনা করা হইয়াছে। এই দ্রলোকের শিক্ষা আভিজাত্যের উপর নির্ভর করিত কিন্তু গণতন্ত্র অথবা শিল্পপ্রধান ধনতন্ত্রবাদের যুগে ইহা টিকিয়া থাকিতে পারে না। আভিজাত্য যদি থাকেই তবে বরং শিক্ষিত লোকের দ্বারা গঠিত হইয়াই থাকুক; তবে আভিজাত্য না থাকাই সর্বাপেক্ষা ভাল। এই সম্বন্ধে এখন আর আলোচনা করিয়া লাভ নাই। ইংল্যান্ডে সংস্কার আইন [Reform Bil] ও শস্য আইন [Corn Law] পাশ করার ফলে এবং আমেরিকায় স্বাধীনতার যুদ্ধ [War of Independence] দ্বারা এই সমস্যার সমাধান হইয়াছে। সত্য বটে এখনও ইল্যান্ডে আভিজাত্যের কাঠামো রহিয়াছে কিন্তু ইহার অন্তর্নিহিত মূল ভাব হইল ধনতন্ত্রবাদসঞ্জাত, যাহার সঙ্গে আভিজাত্যের কোনো মিল নাই। ধনী ব্যবসায়ীরা তাহাদের পুত্রদিগকে ভদ্রলোক করিবার বাসনায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান; ধনীর দুলালরা তথায় ব্যবসায়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব অর্জন করে; অর্থের অভাবে তাহাদের অবস্থা যখন খারাপের দিকে যায়, তখন আবার তাহারা অর্থোপার্জনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিতে থাকে। কাজেই দেখা যায়, সমাজ-জীবনের পক্ষে ভদ্রলোকের শিক্ষার বিশেষ কোনো গুরুত্ব নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পরিকল্পনা করিবার সময় এইরূপ অকেজো শিক্ষা উপেক্ষা করা চলে।