এই অবস্থা কিশোরদের জীবনে কিছুটা খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। পিতামাতার প্রতি তাহাদের ভালোবাসা কমিয়া যায় এবং যে সকল লোকের রুচি, কর্মজীবন তাহাদের মতো নয় এইরূপ লোকের সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া চলিবার শিক্ষা তাহারা পায় না। ইহার ফলে স্বার্থপরতা এবং অন্য সকলের সংস্রব নিজেকে দূরে পৃথক করিয়া রাখিবার প্রবণতা দেখা দেয়। এইরূপ মনোভাবের প্রধান প্রতিষেধক হইল পারিবারিক জীবন; পরিবারের একসঙ্গে বিভিন্ন বয়সের বালক-বালিকা বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ বাস করে, তাহাদের ভিন্ন ভিন্ন কাজ আছে। কিন্তু ছাত্রাবাসে শুধু একই ধরনের প্রায় একই বয়সের লোক বাস করে। এইজন্য ইহা পরিবারের অভাব পূরণ করিতে পারে না। সন্তানগণ পিতামাতাকে জ্বালাতন করে বলিয়াই প্রধানত তাহারা তাহাদিগকে ভালবাসেন; পিতামাতা যদি সন্তানদের উপর কাজের চাপ না দেন তবে তাহারাও পিতামাতাকে বিশেষ আমল দিতে চায় না। তবে শাসন এবং কাজের চাপ যেন অস্বাভাবিক না হয় সে বিষয়ে অবশ্য লক্ষ্য রাখিতে হইবে। অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা তরুণদিগকে শিখিতে হইবে; অন্য যে-কোনো স্থান অপেক্ষা গৃহেই ইহা শিক্ষা করা সহজতর। পুত্রকন্যাগণের ইহা জানা ভাল যে, তাহাদের পিতাকে অনেক সময় নানা ঝামেলায় বিব্রত থাকিতে হয়, তাহাদের জননীরও সংসারের নানা খুঁটিনাটি লইয়া ঝামেলা কম নয়। কৈশোরে, কিশোর-কিশোরীরা যখন বাল্যকাল অতিক্রম করিয়া যৌবনে প্রবেশ করে সেই বয়ঃসন্ধির যুগে তাহাদের মনে পিতামাতার প্রতি প্রতিরোধ থাকা চরিত্রগঠনের পক্ষে উপকারী। পারিবারিক প্রীতি সম্বন্ধ না থাকিলে সংসার হয় মাধুর্যবিহীন ও যান্ত্রিক ভাবাপন্ন; এরূপ সংসারে লোকজন প্রত্যেকেই স্বার্থপরভাবে আত্মপ্রাধান্য লাভের চেষ্টা করে এবং অকৃতকার্য হইলে মুষড়াইয়া পড়ে। স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি অপরের সুখদুঃখের অংশভাগী হইতে পারে না, নিজেদের ব্যর্থতার দুঃখ লাঘব করার জন্য তাহারা অপরের সহানুভূতিও পায় না। গৃহের পরিবেশ হইতে দূরে আবাসিক বিদ্যালয়ে বালক বালিকা শৈশব অতিবাহিত করিলে এই কুফল ফলে। আবাসিক বিদ্যালয়ের অন্যান্য কতক সুবিধা কিন্তু তাহার সঙ্গে তুলনায় এই কুফলের গুরুত্বই বেশি।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানী অবশ্য বলেন, পিতা বা মাতার অত্যধিক প্রভাব শিশুর জীবনে খুবই অপকারী। কিন্তু শিশু যেখানেই দুই বা তিন বৎসর বয়স হইতেই বিদ্যালয়ে যাইতে শুরু করে সেখানে এইরূপ প্রভাবের কোনো কারণ আছে বলিয়া মনে করি না। অল্প বয়স হইতেই দিবা-স্কুলে যাইতে আরম্ভ করিলে পিতামাতার অতিরিক্ত শাসন বা একেবারে সম্পর্ক-শূন্যতা-এই দুই চরম অবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান সম্ভবপর হয়। গৃহের পরিবেশ যদি ভাল হয় তবে বাড়ি হইতে দৈনিক স্কুলে গিয়া পড়াশুনা করাই সর্বোত্তম পন্থা।
বোর্ডিং-এ বাস করার আরও একটি অসুবিধা আছে। ভাবপ্রবণ বালককে সমবয়সীদের সঙ্গে রাখায় অনেক সময় বিপদের কারণ ঘটে। বছর বারো বয়সের বালকগণ সাধারণত দুর্দান্ত ভাবপ্রবণ হয়। কিছুদিন আগেও একটি বড় পাবলিক স্কুলে শ্রমিকদলের সমর্থক বলিয়া একটি ছাত্র অন্য ছাত্রগণ কর্তৃক প্রহৃত হইয়া আহত হইয়াছিল। যে-সকল বালক অভিমত ও রুচিতে বেশিরভাগের মতো হইতে পারে না তাহাদের ভাগ্যেই লাঞ্ছনা ঘটিবার সম্ভাবনা। বুয়র যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে সর্বাধুনিক ও প্রগতিশীল বোর্ডিং স্কুলেও বুয়রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছাত্রদের উপর অত্যাচার হইত।
যে বালক বেশি পড়াশুনা করিতে ভালবাসে কিংবা নিজের কাজ অপছন্দ করে না তাহারই অন্য সকলের হাতে লাঞ্ছিত হইবার সম্ভাবনা। ফ্রান্সে বুদ্ধিমান ছাত্রদিগকে পাঠানে হয় ইকোল নর্মাল সুপিরিয়রে অর্থাৎ উচ্চতর ধরনের বিদ্যালয়ে। সেখানে তাহারা মাঝারি ধরনের ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করে না। এই ব্যবস্থার সুবিধা আছে; মেধাবী ছাত্রদিগকে জোর করিয়া সাধারণের পর্যায়ে নামাইয়া রাখা হয় না বা অত্যাচার করিয়া তাহাদিগকে কতকগুলি মাঝারি বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণের স্তাবকে পরিণত করা হয় না। এইরূপ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার ফলে মেধাবী ছাত্রগণ অন্যের অপ্রীতিভাজন হওয়ার হাত হইতে অব্যাহতি পায়। তাহা ছাড়া সকল ছাত্রই তীক্ষ্ণধী হওয়ায় তাহাদের পাঠও দ্রুত অগ্রসর হইতে থাকে, কম বুদ্ধিমান ছাত্র সহপাঠী থাকিলে এত দ্রুত পাঠদান সম্ভবপর হইত না। এইরূপ বিদ্যালয়ের একটি দোষ এই যে, বুদ্ধিমান লোকদিগকে ইহা সমাজের সাধারণ মানুষ হইতে পৃথক করিয়া দেয়; ইহার ফলে ইহাদের পক্ষে সাধারণ মানুষকে বোঝা একটু কঠিন হয়। ইংল্যান্ডের সমাজে উচ্চশ্রেণির বালকদের জন্য যে বিদ্যালয় রহিয়াছে তথায় ভালরকম খেলাধুলা না জানিলে অসাধারণ প্রতিভাবান বালকের উপরও অত্যাচার করা হইয়া থাকে। ইহার তুলনায় ফ্রান্সের উন্নত বিদ্যালয়গুলিতে কিছু সম্ভাব্য অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও সেইগুলি আমার নিকট শ্রেয় বলিয়া মনে হয়।
তবে বালকদের বর্বরতা দুরারোগ্য নয়, বস্তুত পূর্বের তুলনায় ইহা এখন অনেক কমিয়াছে। টম ব্রাউনস্ স্কুল ডে [Tom Browns School Day] পুস্তকে যেইরূপ বিবরণ আছে বর্তমানের পাবলিক স্কুল সম্বন্ধে তাহা প্রয়োগ করিলে অতিরঞ্জন বলিয়া মনে হইবে। যে-সকল বালক বাল্যে উপযুক্ত শিক্ষা পাইয়াছে তাহাদের পক্ষে ইহা আরও কম প্রযোজ্য। আমার মনে হয় সহশিক্ষা বালকদিগকে ভদ্র হইতে অভ্যস্ত করে। বালক ও বালিকার মধ্যে যে প্রকৃতিগত কোনোরূপ পার্থক্য আছে তাহা স্বীকার না করিলেও আমি মনে করি যে, বালকেরা নিজেদের সঙ্গে কাহারও মতের গরমিল হইলেই যেমন দৈহিক অত্যাচার করিতে কসুর করে না, বালিকাদের প্রবৃত্তি সেইরূপ নয়। কোনো বালকের বুদ্ধি যদি অন্যান্য সাধারণ বালকের তুলনায় অধিকতর প্রখর হয় কিংবা নীতিজ্ঞান ও ভাবপ্রবণতায় অনন্য সাধারণ হয় অথবা সে যদি রাজনীতিতে রক্ষণশীল ভাবের সমর্থক ও ধর্মমতে গোঁড়া না হয় তবে তাহাকে পাঠানো চলে এমন বোর্ডিং-স্কুল ইংল্যান্ডে খুব কমই আছে। এইরূপ বালকদের পক্ষে বর্তমানের পাবলিক স্কুলের ব্যবস্থা সন্তোষজনক নহে। অথচ অসাধারণ প্রতিভাবান প্রায় সকল ছাত্রই এইরূপ ছাত্রের দলভুক্ত।