শিক্ষার্থী জীবনের সমগ্র কালটিই বুদ্ধিগত অভিযানের সময় বলিয়া ছাত্রদের মনে সজীব তারুণ্যের ভাব জাগাইয়া রাখিতে হইবে। নিজেদের নির্দিষ্ট পাঠ আয়ত্ত করার পর ছাত্রগণ যাহাতে স্বচেষ্টায় নূতন নূতন তথ্য উঘাটন করিতে পারে সে বিষয়ে তাহাদিগকে উৎসাহিত করিতে হইবে এইজন্য তাহাদের প্রতিদিনকার পাঠ খুব গুরুভার হওয়া উচিত নহে। ছাত্রের কাজ প্রশংসা করিতে হইবে; ভুল হইলে তাহা সংশোধন করিতে হইবে। কিন্তু ভুলের জন্য তাহাকে নিন্দা করা সঙ্গত হইবে না; বোকামি দেখাইলেও ছাত্রগণ যেন লজ্জা অনুভব না করে। চেষ্টা দ্বারা যে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভবপর এই ধারণা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বড় প্রেরণা। যে জ্ঞান নীরস, শিক্ষার্থী যাহা লাভে আনন্দ অনুভব করে না তাহার মূল্য বিশেষ কিছু নাই। সানন্দে সে যাহা নিজস্ব করিয়া লয় তাহাই হয় স্থায়ী এবং কার্যকরি। ছাত্রদিগকে জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্বন্ধ বুঝিতে দিন, জ্ঞানের ভিতর দিয়া কিীবে জগতের পরিবর্তন সাধন সম্ভবপর তাহাও তাহারা উপলব্ধি করুক। শিক্ষক যেন ছাত্রগণ কর্তৃক সহায়রূপে বিবেচিত হন, স্বাভাবিক শত্রুরূপে নয়। প্রথম কয়েক বৎসর উপযুক্ত শিক্ষা পাইলে অধিকাংশ বালক-বালিকাই অধিকতর জ্ঞান অর্জনের কাজ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করিবে।
১৫. দিবা স্কুল ও বোর্ডিং স্কুল
কোনো বালক বা বালিকা বাড়ি হইতেই স্কুল করিবে, না আবাসিক বিদ্যালয়ের বোর্ডিং-এ থাকিয়া পড়াশুনা করিবে, তাহা অবস্থা এবং মনঃপ্রকৃতি বুঝিয়া নির্ধারণ করা উচিত। উভয় ব্যবস্থারই সুবিধা আছে; কোনো কোনো বিষয়ে দিবা স্কুল বেশি সুবিধাজনক, কোনো বিষয়ে আবার আবাসিক স্কুলের সুবিধা বেশি। আমার নিজের ছেলেমেয়ের শিক্ষার ব্যাপারে আমি কোন্ কোন্ যুক্তি বিবেচনা করিব তাহারই উল্লেখ করিতেছি; বিবেকবান অপর মাতাপিতার নিকটও এইগুলি গ্রহণীয় মনে হইতে পারে।
প্রথম বিবেচ্য বিষয় হইল স্বাস্থ্য। স্কুলের সত্যিকারের অবস্থা যাহাই হউক না কেন, গৃহ হইতে স্কুলে ছাত্রের স্বাস্থ্যরক্ষার বেশি সুবন্দোবস্ত করা সম্ভবপর। তথায় সাধারণ চিকিৎসক, দন্তচিকিৎসক এবং শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সর্বাধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন তত্ত্বাবধায়িকা নিযুক্ত করা চলে কিন্তু কর্মব্যস্ত পিতামাতার পক্ষে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা সহজ নহে। ইহা ছাড়া স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিদ্যালয় অবস্থিত হইতে পারে। শহরবাসী পিতামাতার পক্ষে এইরূপ বিদ্যালয়ের প্রতি যথেষ্ট আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক। তরুণদের পক্ষে মফস্বল অঞ্চলে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটানোই ভালো; তাহাদের পিতামাতাকে। শহরে বাস করিতে হইলে শিক্ষার জন্য তাহারা বোর্ডিং স্কুলে থাকিতে পারে। স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল মনে করিয়া বোর্ডিং স্কুলে পুত্রকন্যা পাঠাইবার যে যুক্তি তাহাও বেশিদিন প্রয়োগ করা যাইবে না, কেননা শহরেও লোকের স্বাস্থ্য ক্রমশ। ভালোর দিকে যাইতেছে। লন্ডনে কৃত্রিম অতিবেগুনি আলো [Ultra violet light] প্রয়োগ করিয়া পল্লি অঞ্চলের অনুরূপ স্বাস্থ্যবিধানের ব্যবস্থা হইতেছে। তবু শহরে রোগের প্রকোপ কমাইতে পারিলেও শিশুদের স্নায়ুর উপর কুফল বিস্তার করিতে পারে এইরূপ বিষয় থাকিবে। অবিরাম শব্দ ও কোলাহল শিশু এবং বয়স্ক সকলের পক্ষেই খারাপ; পল্লির দৃশ্য, ভেজা-মাটির গন্ধ, বাতাস, নক্ষত্র প্রভৃতি প্রত্যেক নরনারীর স্মৃতিতে জমাইয়া রাখা উচিত। কাজেই আমার মনে হয়, শহরে স্বাস্থ্যের উন্নতি হোক না কেন, বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময় কিশোর-কিশোরীদের পল্লি অঞ্চলে বাস করার বিশেষ প্রয়োজন আছে।
আবাসিক বিদ্যালয়ের পক্ষে আর একটি যুক্তি যদিও খুব প্রবলযুক্ত নয়। অনেকেরই বাড়ির কাছাকাছি ভাল স্কুল থাকে না, বাড়ি হইতে স্কুলের দূরত্ব বেশ কিছুটা হইতে পারে। পল্লিবাসীদের পক্ষে এ যুক্তির গুরুত্ব আছে; স্বাস্থ্যের অনুকূল যুক্তিটি শহরবাসীদের প্রতি প্রযোজ্য।
শিক্ষাপ্রণালীতে যখন কোনো নূতন পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়, তখন আবাসিক বিদ্যালয় না হইলে চলে না করণ যে সকল পিতামাতা এইরূপ পরীক্ষার পক্ষপাতী তাঁহারা যে একই অঞ্চলে বাস করিবে এবং নিজেদের পুত্রকন্যাদিগকে একই দিবা স্কুলে পাঠাইবেন এইরূপ আশা করা যায় না। শিশুদের বেলায় এইকথা প্রযুক্ত হয় না। তাহারা তখনও শিক্ষা-কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ আওতার মধ্যে আসে না। এইজন্য মাদাম মন্তেসরি এবং শ্রীমতী ম্যাকমিলান অত্যন্ত গরিব শিশুদের উপর তাহাদের শিক্ষাপ্রণালীর পরীক্ষা করার সুযোগ পাইয়াছিলেন। পক্ষান্তরে বালক-বালিকার বিদ্যালয়-জীবন শুরু হইলে কেবল ধনীব্যক্তিরাই তাহাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সম্বন্ধে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারে। বেশিরভাগই পুরাতন গতানুগতিক পন্থাই পছন্দ করে। যে সামান্য কতকজন নূনতত্ব চাহে তাহারা দেশর মধ্যে ইতস্তত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বলিয়া তাহাদের ছেলেমেয়েদের একই দিবাস্কুলে পাঠাইতে পারে না। কাজেই এইরূপ ক্ষেত্রে বোর্ডিং স্কুলই গবেষণা ও নূতন প্রণালী পরীক্ষার একমাত্র স্থান হইয়া দাঁড়ায়।
বোর্ডিং স্কুলের বিরুদ্ধে যুক্তিগুলিও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। স্কুল জীবনের অনেক দিকই অপ্রকাশিত থাকিয়া যায় : স্কুল একটি কৃত্রিম জগৎ। এখানকার সমস্যা আর বহির্জগতের সমস্যা একই জাতীয় নয়। যে বালক বোর্ডিং স্কুলে থাকে, কেবল ছুটির দিনে বাড়িতে আসে এবং তাহার ফলে সকলেই তাহার প্রতি স্নেহের আতিশয্য প্রকাশ করে, সংসার সম্বন্ধে সে যতটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি অভিজ্ঞতা লাভ করে সেইসব বালক যাহারা প্রতি সকাল-বিকাল বাড়িতে থাকে। মেয়েদের সম্বন্ধে এইকথা ততখানি সত্য নয় কেননা অনেক বাড়িতেই আজকাল তাহাদিগকে অনেক কিছু করিতে হয়। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষা যতই বালকদের অনুরূপ হইবে ততই তাহাদের গৃহের জীবনও বালকদের মতো হইতে থাকিবে এবং আবাসিক বিদ্যালয়ে বাস করার ফলে গার্হস্থ্য-জীবন সম্বন্ধে তাহাদের জ্ঞান লোপ পাইবে। পনেরো-ষোলো বৎসর বয়সের পর পুত্রকন্যাদের পিতামাতার পেশা ও সাংসারিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সংসারে সমস্যা বা অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা বেশি পরিমাণে তাহাদের উপর চাপিলে পড়াশুনার বিঘ্ন হইতে পারে কিন্তু তবু তাহাদের কিছু কিছু উপলব্দি করা উচিত যে, বয়স্ক ব্যক্তিদের নিজেদের জীবন আছে, আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে। সংসারের জন্য তাহাদের প্রয়োজনও আছে। স্কুলে কিশোর তরুণ ছাত্রগণই সব; তাহাদের জন্যই সব কিছু করা হয়। ছুটির দিনে, উৎসবের দিনে তরুণদেরই প্রাধান্য। কাজেই আবাসিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উদ্ধতভাবে গড়িয়া উঠার দিকে ঝোঁক দেখা যায়; বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনের সমস্যা সম্বন্ধে তাহারা বিশেষ কোনো খোঁজখবর রাখে না, পিতামাতার সংস্রব হইতেও তাহারা দূরে থাকিয়া যায়।