মনের এই অভ্যাস দূর করিবার উপায় হইল–বিপদ আসিতে পারে ভাবিয়া তাহার জন্য মনে মনে প্রস্তুত থাকা এবং ভয়কে সম্পূর্ণরূপে মনে স্থান না দেওয়া। ভয়ের জন্যই মানুষ বিপদের সম্মুখীন হইতে ইচ্ছা করে না। যে ব্যক্তি নিজের বিপদের কথা চিন্তা করিতেই সাহস পায় না সে যদি হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকার শুনিয়া ঘুম হইতে জাগিয়া ওঠে, তবে প্রথমেই সে ভাবিবে অন্য কাহারও বাড়িতে আগুন লাগিয়াছে; এবং আগুন যদি তাহার নিজের বাড়িতেই হয় তবে হয়তো যে সময়ে চেষ্টা করিলে নিরাপদ বাহিরে আসিতে পারিত। তাহার পরে সচেতন হইয়া বাহির হইবার পথ পর্যন্ত পাইবে না। অবশ্য কেবল মনোরোগীর ক্ষেত্রে এইরূপ ঘটিতে পারে। কিন্তু রাজনীতিতে এইরূপ আচরণ খুবই স্বাভাবিক। যে সকল ক্ষেত্রে চিন্তা দ্বারা যথার্থ পন্থা বাছিয়া লইতে হয় তথায় ভয় মানসিক আলোড়ন সৃষ্টি করিয়া তাহাকে বিঘ্ন উৎপাদন করে এবং বিপদের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। কাজেই ভীত না হইয়া আমরা বিপদের সম্ভাবনা সম্বন্ধে অবহিত হইতে চাহি। আর সেই সঙ্গে যাহা অনিবার্য নয়, বুদ্ধি এইরূপ বিপদের হাত হইতে অব্যাহিত পাইতে চাই। যে বিপদ সত্যই অনিবার্য এবং অপ্রতিরোধ্য, সাহসের সঙ্গে তাহা গ্রহণ করাই সমীচীন। এইরূপ বিপদের ক্ষেত্রে কি করা উচিত তাহা এখানে আলোচ্য বিষয় নহে।
পূর্বের এক অধ্যায়ে ভয় সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি তাহার পুনরুল্লেখ করিতে চাহি না। বুদ্ধির ক্ষেত্রে ভয় কিভাবে যথার্থ প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়ায় এইস্থানে শুধু তাহা বলা হইতেছে। এইরূপ ক্ষেত্রে পরবর্তী বয়স অপেক্ষা প্রথম জীবনেই ইহা জয় করা সহজ, কেননা কোনো বালক বা বালিকা যদি মতের পরিবর্তন করে তবে তাহাতে এমন কোনো গুরুতর বিপদপাত ঘটে না কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তির জীবন ও কর্মধারা কতকগুলি নীতি ও অভিমতের উপর গড়িয়া ওঠে; অকস্মাৎ তাহার পরিবর্তন করিলে বিপর্যয় ঘটা সম্ভব। এইজন্য কিছু অধিক বয়স্ক বালক বালিকাকে আমি স্বাধীন মতামত প্রকাশ ও বিতর্ক করার সুযোগ দিতে চাই। তাহার যদি আমি যাহা একান্ত সত্য বলিয়া মানি তাহার সত্যতা সম্বন্ধেও প্রশ্ন করে আমি তাহাতে বাধা দিব না। আমি তাহাদিগকে চিন্তা করিতে শিখাইতে চাই। প্রচলিত গোঁড়া মতবাদ কিংবা তাহার বিরুদ্ধে অভিমত–কোনোটিই তাহাদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিবা না; তাহারা নিজেরাই আলোচনা ও বিতর্কের ভিতর দিয়া সত্যের সন্ধান করুক, ইহা চাই। কল্পিত নীতির [Moral] নামে বুদ্ধির বলিদান আমি কখনই সমর্থন করিব না। সাধারণত লোকের ধারণা এই যে, উপদেশ দান কালেই কিছুটা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়। রাজনীতিতে আমরা আপন দলের খ্যাতনামা রাজনীতিকদের দোষগুলি গোপন করি। ধর্মনীতিতে ক্যাথলিকরা গোপদের এবং প্রোটেস্ট্যান্টরা লুথার ও ক্যালভিনের পাপ গোপন করে। যৌন ব্যাপারে আমরা কিশোরদের কাছে এই ভান করি যে, সংযম প্রভৃতি গুণ আয়ত্ত করা খুব কঠিন নয়। সকল দেশে পুলিশ যাহা অবাঞ্ছনীয় মনে করে তাহা বয়স্ক ব্যক্তিদিগকেও জানিতে দেওয়া হয় না এবং ইংল্যান্ডে সেন্সর মনে করেন যে মানবসমাজের বাস্তব অবস্থা নাটকের মারফত নাট্যমঞ্চে অভিনীত হইতে দেওয়া উচিত নহে, বাস্তব চিত্র দেখাইয়ে নয়, ফাঁকিতে ভুলাইয়া রাখিয়াই মানুষকে ধার্মিক ও গুণবান করিয়া তোলা যায় ইহাই তাহার ধারণা। এই সমস্তই দুর্বল মনের পরিচায়ক। সত্যের স্বরূপ যাহাই হউক না কেন আসল সত্যই আমাদের জানা উচিত; তাহা হইলেই আমরা যথাযথ বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া কাজ করিতে পারিব। কৃতদাসগণ যাহাতে নিজেদের স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন হইয়া উঠিতে না পারে সেইজন্য শক্তিমান ব্যক্তি তাহাদের নিকট হইতে সত্য গোপন রাখিবে। ইহার উদ্দেশ্য বোঝা যায় কিন্তু যেখানে গণতন্ত্র বিরাজিত তথাও লোকে স্বেচ্ছায় এমন আইন রচনা করিবে যাহাতে সত্য তাহারা জানিতে না পারে। এই বিষয়টি দুর্বোধ্য! দেশের সব লোকই যেন ডনকুইকজোটে পরিণত হইয়াছে। তাহারা যেন শুনিতে চাহে না যে, তাহাদের শিরস্ত্রাণ তাহারা যেইরূপ মনে করে ততখানি শক্ত নয়। এইরূপ হীন ভীতি স্বাধীন নরনারীর পক্ষে শোভা পায় না। আমার স্কুলে জ্ঞানের প্রতিবন্ধক কোনো কিছু থাকিবে না। মিথ্যা ও ভাওতা দ্বারা নয়, ছাত্রদের প্রবৃত্তি ও আবেগ যথোপযুক্তভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়া আমি তাহাদের সাহস ও অন্যান্য গুণ বিকাশের সহায়তা করিব। এইরূপ গুণবিকাশের ক্ষেত্রে ভীতিরহিত হইয়া জ্ঞান এবং সত্যের অনুশীলন একান্ত আবশ্যক, নতুবা গুণগুলির বিশেষ কোনো মূল্য থাকে না।
বৈজ্ঞানিক মনোভাবের উন্মেষ : আমি যাহা বলিতে চাই তাহা এই যে; ছাত্রদের মধ্যে আমি বৈজ্ঞানিকসুলভ মনোভাব গড়িয়া তুলিব। অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী নিজেদের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রের বাহিরে এই মনোভাব প্রয়োগ করেন না। বৈজ্ঞানিক মনোভাবের প্রথম প্রয়াস হইল সত্য নির্ধারণের বাসনা। এই বাসনা যত প্রবল হয় ততই ভালো, ইহার সঙ্গে বুদ্ধি বৃত্তিজাত কতকগুলি গুণও জড়িত। কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রথমে অনিশ্চয়তার ভাব থাকিবে, পরে প্রমাণ দ্বারা তাহার সত্যাসত্যর নির্ধারণ করিতে হইবে। সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখিয়া কি জানা যাইবে তাহা আমরা আগেই জানি, এই ধরনের মনোভাব পোষণ করা উচিত নয়, কিংবা সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা কিছুই হইবে না–এই ধরনের আলস্যপ্রসূত সংশয় মনে স্থান দেওয়াও অনুচিত। ইহা আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আমাদের বিশ্বাসগুলিরও হয়তো কিছু কিছু সংশোধন আবশ্যক হইতে পারে। যে-কোনো বিষয়ে চরম সত্য জানা গিয়াছে এইরূপ মনে করার কোনো কারণ নাই। বিভিন্ন যুগে মানুষের অধিগত জ্ঞানের মাত্রা কমবেশি হইয়াছে। পদার্থবিদ্যা সম্বন্ধে মানুষের বিশ্বাস গ্যালিলিওর সময়ের পূর্বে যেমন ছিল, এখন তাহা অপেক্ষা আমাদের ধারণা অনেক বেশি সত্য। এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই পূর্ব নির্ধারিত অভিমত একান্ত সত্য বলিয়া গ্রহণ না করিয়া এই সম্বন্ধে পর্যবেক্ষণ করার ফলেই নূতন তথ্য জানা গিয়াছে। এইজন্যই প্রাথমিক অনিশ্চয়তার অর্থাৎ পূর্ব হইতেই কোনো বিষয় চরম সত্য বলিয়া গ্রহণ না করার একান্ত আবশ্যকতা আছে। ছাত্রদিগকে এই শিক্ষা দিতে হইবে এবং এই সঙ্গে প্রমাণ প্রয়োগের কৌশলও শিখাইতে হইবে। জগতে যখন নানা অভিসন্ধিপূর্ণ নানা লোক মিথ্যা প্রচার করিয়া সকলকে বিভ্রান্ত করিতে চেষ্টা করিতেছে তখন সত্য-মিথ্যা যাচাই করিয়া লইবার মানসিক অভ্যাস গড়িয়া তোলা বিশেষ প্রয়োজন। বারংবার একটি মিথ্যা শুনিতে শুনিতে তাহাকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করার প্রবণতা বর্তমান যুগের এটি অভিসম্পাতস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। স্কুলের শিক্ষার ভিতর দিয়া ইহা প্রতিরোধ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে হইবে।