যুক্তিতর্ক শিক্ষা : নিয়মিত অধ্যয়ন ও তৎসংক্রান্ত অন্যান্য কাজ ছাড়াও বালক-বালিকাদিগকে বর্তমানকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় বিতর্কমূলক প্রশ্নগুলির সহিত পরিচিত করাইতে হইবে। এই প্রশ্নগুলির শুধু একদিকে নয়, সকল দিকের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিতর্ক জানিবার জন্য তাহাদিগকে রীতিমত পড়াশুনা করিতে হইবে। কেহ যদি কোনও এক পক্ষ সমর্থনযোগ্য মনে করে তবে তাহার বিপরীত মত পোষণকারীকে যুক্তিতর্ক দ্বারা তাহা বুঝাইতে হইবে। এইভাবে বিতর্কসভার পরিচালনা করা উচিত। সত্য নির্ধারণের জন্য যথার্থ বিতর্কের যথেষ্ট মূল্য আছে। এইসকল বিতর্কসংকুল প্রশ্নের কোনো বিশেষ দিকের প্রতি শিক্ষকের গভীর আস্থা থাকিলেও তাঁহার কোনো পক্ষ গ্রহণ করা উচতি হইবে না। যদি প্রায় সকল ছাত্রই এক পক্ষ গ্রহণ করে তখন আলোচনা চালাইবার জন্য কেবল তর্কের খাতিরেই এক পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করিতেছেন এইকথা বলিয়া তিনি যুক্তিতর্কে অবতীর্ণ হইতে পারেন। তাহা না হইলে তাহার কর্তব্য হইবে ছাত্রদের যুক্তি বিষয়বস্তুতে ভুল থাকিলে তাহা সংশোধন করিয়া দেওয়া। এইভাবে বিতর্ক ও আলোচনার দ্বারা ছাত্রগণ সত্য নির্ধারণ করিতে শিখিবে; কথার জাল বুনিয়া বাকযুদ্ধে জয়ী হওয়া তর্ক বা বিতর্কের উদ্দেশ্য নয়।
আমি যদি বয়স্ক বালক-বালিকাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হইতাম তবে বর্তমান যুগের সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়াইয়া চলা এবং ইহাদের সম্বন্ধে প্রোপাগান্ডা করা মোটেই বাঞ্ছনীয় মনে করিতাম না। জগৎ সংসারে সকল লোকের নিকট যে-সমস্যা প্রধান বলিয়া মনে হয় তাহা যদি শিক্ষায়তনেও স্বীকৃত ও আলোচিত হয় তবে শিক্ষার্থীরা অনুভব করে যে, তাহারা জগৎ হইতে পিছাইয়া পড়িয়া নাই এবং তাহাদের শিক্ষা তাহাদিগকে জীবনের জন্য প্রস্তুত করিতেছে। তাহারা বুঝিতে পারে যে, পুঁথিগত শিক্ষা তাহাদিগকে বাস্তব জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন। করে না। কিন্তু আমি আমার নিজের অভিমত ছাত্রদের উপর চাপাইতে চাহি না। বাস্তব প্রশ্নের বিশ্লেষণ করিয়া সত্য নির্ধারণ করিতে কিভাবে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে যুক্তিপ্রবণ মনোভাব গ্রহণ করিতে হয় তাহারই আদর্শ আমি ছাত্রদের সম্মুখে স্থাপন করিব। আমি আশা করিব ছাত্রগণ বাজে তর্ক, হইচই করার পরিবর্তে সুযুক্তি প্রয়োগ করিতে শিখিবে। রাজনীতি ক্ষেত্রে বিশেষ করিয়া এই অভ্যাস খুব মূল্যবান কিন্তু খুবই বিরল। প্রত্যেক উগ্র রাজনৈতিক দল গুটিপোকার মতো কতকগুলি ভ্রান্ত ধারণার আবরণের আড়লে মানসিক দিক দিয়া নিশ্চিন্তে নিষ্ক্রিয় হইয়া থাকে। উত্তেজনা অনেক সময় বুদ্ধিনাশ করে; পক্ষান্তরে বুদ্ধিপ্রধান ব্যক্তিগণের জীবনে দেখা যায় বিচার-বুদ্ধি তাহাদের ভাবের আবেগ নাশ করিয়া তাহাদিগকে শুষ্ক নীরস ব্যক্তিতে পরিণত করে। এই দুই অবস্থার কোনোটিই কাম্য নয়; এই দুই অবস্থাই এড়াইতে পারিলেই ভালো। ভাবাবেগ বাঞ্ছনীয় যদি ইহা ধ্বংসমুখি না হয়; বুদ্ধির বেলাতেও সেই কথা খাটে। আমি আশা করিব রাজনৈতিক ভাবাবেগ হইবে গঠনমূলক এবং বুদ্ধি এই আবেগ সফল করিয়া তুলিতে সাহায্য করিবে। বুদ্ধির কাজ হইবে কতকগুলি অলীক কল্পনার রাজ্য ভাবাবেগকে চালিত না করিয়া বাস্তব এবং প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলজনক কার্যে ইহাকে নিয়োগ করা। বাস্তব জগতে আমরা যখন কোনো বাঞ্ছিত বিষয়লাভে অসমর্থ হই, তখন আমরা কল্পনার আশ্রয় লই যথায় চেষ্টা ব্যতিরেকেই আমাদের কামনা তৃপ্তি লাভ করে; বাস্তবের রূঢ় আঘাত মনকে কোমল কল্পনার জগতে ঠেলিয়া দেয়। ইহাই হিস্টিরিয়া রোগের মূল কারণ। ইহা উগ্র জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত, ধর্মতত্ত্বগত ও শ্রেণিগত ভ্রান্ত ধারণাও মূল কারণ। ইহা চরিত্রের দুর্বলতার পরিচায়ক; এইরূপ দুর্বলতা বর্তমান যুগে প্রায় সর্বজনীন হইয়া পড়িয়াছে। চরিত্রের এই দুর্বলতা জয় করা বয়স্ক ছাত্রদিগকে শিক্ষাদানের সময় আদর্শ বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। এই চারিত্রিক দুর্বলতা দূর করিবার দুইটি উপায় আছে, যদিও ইহাদিগকে পরস্পরবিরোধী মনে হইতে পারে। প্রথমত, এই বাস্তব জগতে কতখানি কাজ আমাদের সাধ্যায়ত্ত সেই সম্বন্ধে ধারণা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, রূঢ় বাস্তবতা কেমন করিয়া আমাদের স্বপ্ন কল্পনা ভাঙিয়া দিতে পারে সেই সম্বন্ধে অধিকতর সচেতন হওয়া। ওই উভয় প্রক্রিয়ারই মূলনীতি এক অলস কল্পনার রাজ্যে ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে বাস না করিয়া আমাদিগকে বলিষ্ঠচিত্ত ও বস্তুনিষ্ঠ হইতে হইবে।
আত্মমুখিতার একটি প্রধান উদাহরণ ডন কুইকজোট। প্রথমে সে যখন একটি শিরস্ত্রাণ তৈয়ার করে, ইহার আঘাত সহ্য করিবার পক্ষে যথেষ্ট শক্ত হইয়াছে কি না পরীক্ষা করিতে গিয়া সে শিরস্ত্রাণটিকে পিটিয়া বিকৃত করিয়া ফেলে। পরে যখন অন্য একটি তৈয়ার করিল সে আর পরীক্ষা করিয়া দেখিল না, মনে করিল সেইটি চমৎকার হইয়াছে। এইরূপ মনে করিবার অভ্যাস তাহার সমগ্র জীবন প্রভাবিত করিয়াছে। অপ্রীতিকর কোনো অবস্থার সম্মুখিন না হওয়াও এই একইরূপ মনোভাবের ফল; আমরা সকলেই কমবেশি রকমের ডন কুইকজোট। ডনকুইকজোট যদি স্কুলে ভাল শিরস্ত্রাণ নির্মাণ করিতে শিখিত এবং তাহার সঙ্গীরা যদি সে যাহা ভাল বলিয়া মনে করে তাহাই বিনা প্রতিবাদে ভালো বলিয়া মানিয়া না লইত তবে সে এইরূপ আচরণ করিত না। শিশুরা যখন দুর্বল থাকে এবং মনের বাসনাকে কার্যে পরিণত করিতে পারে না তখন তাহাদের পক্ষে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করা শোভন এবং স্বাভাবিক। এইরূপ মনোবিলাস তাহাদের মানসিক রোগের পরিচায়ক নয়। কিন্তু বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের ইহা উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে কল্পনা কেবল অবাস্তব কল্পনারূপে মনে বাসা বাঁধিয়া থাকিলে কোনো লাভ নাই। আগে হউক আর পরেই হউক কল্পনাকে যতখানি বাস্তবে পরিণত করা যায় ততখানিই ইহার সার্থকতা। বালকেরা যেমন অন্য বালকদিগের ব্যক্তিগত অহমিকা দূর করিতে পারে এমন আর কেহ পারে না। সঙ্গীদের সঙ্গে মিশিয়া কোনো বালকের পক্ষে নিজের অসাধারণ ক্ষমতার বড়াই করা সম্ভবপর হয় না, কেননা তাহাদের নিকট তাহার দোষগুণ বিশেষ ঢাকা থাকে না। কিন্তু অনেক সময় শিক্ষকদিগের সহযোগিতায় নূতন ধরনের দন্ড ছাত্রদের মনে দানা বাঁধিয়া ওঠে। যেমন: নিজের স্কুল সকল স্কুলের অপেক্ষা ভালো, নিজের দেশ সকল দেশের সেরা, নিজের সামাজিক শ্রেণি (ছাত্র যদি অভিজাত বংশসস্তৃত হয়) অন্য যে-কোনো শ্রেণি হইতে শ্রেষ্ঠ। এ সমস্তই অবাঞ্ছনীয় মনোভাব। ইহা আমাদের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করে যে, আমাদের শিরস্ত্রাণ খুব মজবুত কিন্তু কার্যত হয়তো অন্যের তরবারি ইহা দুই খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিতে পারে। এইভাবে নিজের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা আলস্য উৎপাদনের সাহায্য করে এবং শেষ পর্যন্ত অলস কল্পনাবিলাসী লোকদিগকে বাস্তব বিপদের দিকে ঠেলিয়া লইয়া যায়।