কতকগুলি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় আছে তাহা প্রত্যেকের জানা উচিত। শারীরস্থান [Anatomy], শারীরবৃত্ত [Physiology] এবং স্বাস্থ্যবিদ্যা [Hygiene] বয়স্ক ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে যে পরিমাণে কাজে লাগে তাহা অবশ্য শিক্ষণীয়। এই বিষয়গুলি যৌনশিক্ষারও সঙ্গে সংযুক্ত, কাজেই হয়তো ছাত্ররা এই শিক্ষা মোটামুটিভাবে আগেই পাইয়াছে, কারণ যৌবনাগমের পূর্বেই যৌনশিক্ষা দেওয়া উচিত। খুব বেশি বা কম বয়সে যৌন শিক্ষাদানের বিরুদ্ধে যুক্তি এই যে, যখন এই সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন তাহার পূর্বেই ছাত্র যাহাতে ইহা ভুলিয়া না যায়। আমার মনে হয় এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হইল দুইবার এই শিক্ষা দেওয়া একবার যৌবনাগমের পূর্বে খুব সরল এবং মোটামুটিভাবে এবং পুনর্বার স্বাস্থ্য এবং রোগ সংক্রান্ত আলোচনার সময়। ইহা ছাড়া প্রত্যেক ছাত্রেরই পার্লামেন্ট এবং শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে কিছু কিছু জানা আবশ্যক; কিন্তু লক্ষ্য রাখিতে হইবে এই সম্পর্কে শিক্ষাদান যেন রাজনৈতিক প্রচারকার্য হইয়া না দাঁড়ায়।
পাঠ্যক্রমের তুলনায় শিক্ষাদান-রীতি এবং শিক্ষকের আন্তরিকতার প্রশ্নই প্রধান। শিক্ষাগ্রহণ কাজ খুব সহজ না করিয়াও কিভাবে আনন্দদায়ক করা যায় তাহাই হইল প্রধান সমস্যা। ছাত্রদিগকে উন্নততর শিক্ষা অর্জন করিতে কঠোর পরিশ্রম করিতেই হইবে। তবে এইরূপ পরিশ্রম লাঘব করিবার জন্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন পুস্তক পাঠ ও বৃক্ততার আয়োজন করা চলে। যেমন কোনো গ্রিক ভাষার নাটক পড়িতে আরম্ভ করার আগে গিলবাট মারে কিংবা অন্য কোনো কবিত্ব শক্তি সম্পন্ন অনুবাদক কর্তৃক অনূদিত গ্রিক নাটক ছাত্রদিগকে পড়িতে দেওয়া উচিত। অঙ্ক শিক্ষার ব্যাপারেও তেমনই অঙ্ক আবিষ্কারের ইতিহাস, বিভিন্ন বিজ্ঞান এবং দৈনন্দিন জীবনের উপর অঙ্কের প্রভাব আলোচনা করা যায়। উচ্চতর ধরনের অঙ্কের মধ্যে যে অনেক আনন্দের উপাদান আছে তাহার ইঙ্গিতও দেওয়া উচিত। অনুরূপভাবে ইতিহাস শিক্ষাও ছাত্রদের নিকট প্রীতিপদ করা চলে। মাঝে মাঝে ইতিহাস প্রসঙ্গ আলোচনা করিয়া ছাত্রদিগকে বিস্তৃততর পাঠে উদ্বুদ্ধ করা চলে, যেমন ইতিহাসের কোনো ঘটনা বা গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কোনো ব্যাপক মন্তব্য করিয়া তাহা সত্য কি না প্রমাণ করিবার জন্য ছাত্রদিগকে অধিকার পাঠে উৎসাহিত করা যায়। বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণ যে সকল সহজ পাঠ্যপুস্তকে প্রকাশিত হয় সেইগুলি পাঠ করিয়া ছাত্রগণ বিজ্ঞানের যে দিকটা পাঠ করিতেছে তাহা বর্তমানে কোন্ পথে চলিতেছে, তাহার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাই বা কিরূপ ইহাও ছাত্রগণ বুঝিতে পারিবে।
এখানে যে প্রণালীর উল্লেখ করা হইল তাহা কেবল শিক্ষার্থীদিগকে গভীরতর পাঠে এবং কঠোরতম অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত করিবার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা উচতি; বিস্তৃততর পাঠে আত্মনিয়োগ না করিয়া ছাত্রগণ যদি এইরূপ আলোচনা বা বহিরঙ্গকেই উন্নততর পর্যায়ের পাঠ বলিয়া গ্রহণ করে তবে ইহা ক্ষতিকর হইবে। জ্ঞানার্জনের সহজ পন্থা আছে ছাত্রদের মনে এই ধরনের ভাবগড়িয়া উঠিতে দেওয়া কখনই সমীচীন নয়। পূর্বে শিক্ষার্থীকে পাঠ অনুশীলনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করিতে হইত; তাহার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বর্তমান পাঠ্যানুশীলকে অত্যন্ত লঘু এবং আরামের কাজ করিবার ঝোঁক দেখা দিয়াছে। এইখানেই আধুনিক শিক্ষার প্রকৃত বিপদ নিহিত। প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতিতে পাঠ্য অনুশীলনের জন্য কঠোর মানসিক পরিশ্রম সত্যই উপকারী ছিল। কিন্তু এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীর বুদ্ধিদীপ্ত অনুরাগ নষ্ট করিয়া ফেলিত, ইহাই ছিল তখনকার শিক্ষাপ্রণালীর প্রধান দোষ। জ্ঞানার্জনের জন্য মানসিক পরিশ্রমের একান্ত প্রয়োজন আছে কিন্তু পূর্বের শিক্ষাবিগণ ইহাকে যেমন নীরস যান্ত্রিক পর্যায়ে ফেলিয়াছিলেন তেমন না করিয়া অন্য উপায়ে আমাদিগকে ইহার অভ্যাস প্রবর্তন করিতে হইবে। ইহা অসম্ভব বলিয়া আমি মনে করি না। আমেরিকায় এমন দেখা গিয়াছে যাহারা স্কুলের পড়াশুনায় অলস ছিল তাহারাই আইন বা ডাক্তারি পড়িবার সময় কঠোর পরিশ্রমের কাজে স্বেচ্ছায় ব্রতী হয়। তাহার কারণ শেষোক্ত কাজে তাঁহারা গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। মূল কথা এইখানেই : স্কুলের কাজ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় ছাত্রের মনে এই বোধ জাগাইয়া দিন, তবেই তাহারা ইহার জন্য কঠোর পরিশ্রম করিতে কুণ্ঠিত হইবে না। কিন্তু আপনি যদি কাজটি খুবই সহজ করিয়া দেন তবে তাহারা সহজেই বুঝিতে পারিবে আপনি তাহাদিগকে এমন কিছু দিতেছেন না যাহা বিশেষ মূল্যবান ও যাহা আয়ত্ত করা পরিশ্রম সাপেক্ষ। হরিণ যেমন কলাগাছে শিং ঠুকিয়া আনন্দ পায় না, শক্ত গাছের সঙ্গে শিং ঘষিতে চায় তেমনই বুদ্ধিসম্পন্ন বালক-বালিকা কঠিন বিষয় আয়ত্ত করিতে আনন্দ বোধ করে। উপযুক্ত পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ভিতর দিয়া ছাত্রদের ভীতি দূর করিতে পারিলে অনেক বালক-বালিকা, যাহাদিগকে এখন বোকা এবং অলস বলিয়া মনে হয়, তাহারাই রীতিমত বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে।
শিক্ষার সকল স্তরেই শিক্ষার জন্য আগ্রহ ও উদ্যম ছাত্রদের মধ্য হইতেই প্রকাশ হওয়া উচিত। শিশুদের মধ্যে কিভাবে এই উদ্যম ও শিক্ষালাভের প্রয়াস সৃষ্টি করা যায় তাহা মাদাম মন্তেসরি দেখাইয়াছেন। অধিক বয়স্ক শিশুদের বেলায় ভিন্ন প্রণালী অবলম্বন করার প্রয়োজন হয়। প্রগতিশীল সকল শিক্ষাবিদই এখন স্বীকার করেন যে, একই শ্রেণিতে অনেক ছাত্র বা ছাত্রী একত্রে কাজ করিতে থাকিলেও ছাত্রের ব্যক্তিগত কাজের উপরই বেশি জোর দেওয়া উচিত। গ্রন্থাগার এবং বিজ্ঞানশালা [Laboratory] সুসজ্জিত এবং প্রশস্ত হওয়া উচিত। দিনের বেশ কিছুটা সময় ছাত্র নিজের ইচ্ছামত স্বাধীনভাবে কাজ করিবার সুযোগ পাইবে; সে কোন বিষয় পড়িতেছে এবং সে সম্বন্ধে কতটুকু জ্ঞাতব্য বিষয় সংগ্রহ করিয়াছে তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখিয়া রাখিবে। ইহার ফলে পঠিত বিষয় তাহার স্মৃতিতে স্পষ্টতর হইবে, উদ্দেশ্যবিহীন এলোমেলো পাঠের পরিবর্তে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছিবার জন্য পাঠ হইবে উদ্দেশ্যযুক্ত শিক্ষক ও ছাত্রকে যখন যেটুকু সাহায্য করা প্রয়োজন তাহা করিয়া তাহাকে ঠিক পথে নিয়ন্ত্রিত করিবার সুযোগ পাইবেন। ছাত্র যত বেশি বুদ্ধিমান হইবে তত কম নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক হইবে। কমবুদ্ধি ছাত্রদিগকে অধিকতর সাহায্য ও পরিচালনার প্রয়োজন হইবে; কিন্তু এইরূপ ক্ষেত্রেও পরিচালনার অর্থ ছাত্রকে কোনো নির্দিষ্ট কার্য করিতে আদেশ করা নয় অভিভাবন [Suggestion], অনুসন্ধান ও উৎসাহ দ্বারা তাহাকে আত্মচেষ্টায় জয়যুক্ত হইতে অনুপ্রাণিত করা। ছাত্রদের জন্য কতকগুলি বিষয় নির্ধারিত করিয়া দিতে হইবে এবং প্রথমে সহজ হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমশ কঠিনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে কতকগুলি অনুশীলনী তাহাদিগকে আয়ত্ত করাইতে হইবে। এইভাবে তাহার স্বচেষ্টায় সাফল্য লাভের সম্ভাবনা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস অর্জন করিতে পারিবে।