প্রাচীন সাহিত্য : গণিত ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কেও তাহাই প্রযোজ্য। বারো হইতে চৌদ্দ বৎসর বয়সের মধ্যে প্রাচীন ভাষা (যেমন ল্যাটিন) ততটুকুই শিক্ষা দিতে হইবে যাহা হইতে বোঝা যায় কোনো বালকের বা কোনো বালিকার ইহার প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগ এবং দক্ষতা আছে। আমি মনে করি যে, চৌদ্দ বৎসর বয়স হইতেই ছাত্রের রুচিপ্রবণতা ও ক্ষমতা অনুসারে বিশেষ এবং উন্নত মানের শিক্ষা শুরু হওয়া উচিত। শিশুকে পরবর্তিকালে কী শিক্ষা দিলে ভালো হইবে তাহা ছাত্রের চৌদ্দ বৎসর বয়ঃপ্রাপ্তির কিছু পূর্ব হইতেই বিশেষভাবে নিরূপিত হওয়া আবশ্যক।
বহিঃপ্রকৃতির সহিত পরিচয় : সারা স্কুল জীবন ধরিয়াই বাহিরের সহিত পরিচয় চলিতে থাকিবে। অবস্থাপন্ন লোকের সন্তানদের বেলায় ইহার ভার ছাত্রের পিতামাতার উপর দেওয়া চলে কিন্তু অপর ছাত্রদের বেলায় এইরূপ পরিচয় সাধনের দায়িত্ব বিদ্যালয়কেই আংশিকভাবে গ্রহণ করিতে হইবে। আমি যখন বাহিরের বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার কথা বলিতেছি তখন আমি খেলাধুলার কথা ভাবিতেছি না। ইহার অবশ্য উপকারিতা আছে এবং তাহা রীতিমতভাবে স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু অন্য ধরনের বহির্বিষয়ের শিক্ষার কথা বলিতেছি–যেমন চাষ-আবাদের প্রণালী, গাছপালা ও জীবজন্তু চেনা, বাগানের কাজের সঙ্গে পরিচয়, পলি-পর্যবেক্ষণ এবং অনুরূপ বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান। আমি দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি যে, এমন শহুরে লোক আছে যাহারা কম্পাস বা দিগদর্শন-যন্ত্রের চিহ্ন বোঝে না। সূর্য কোন্ দিকে যায় জানে না, গৃহের কোন্ দিকটি বায়ুপ্রবাহের আড়ালের দিকে পড়ে জানে। প্রত্যেক গরু কিংবা ভেড়ার যে জ্ঞান সেইরূপ জ্ঞান হইতেও বঞ্চিত। ইহা নিরবচ্ছিন্নভাবে কেবল শহরে বাস করার কুফল। যদি বলি শ্রমিকদল যে পল্লি অঞ্চলে ভোটে জয়ী হইতে পারে না ইহা তাহার অন্যতম কারণ, তবে হয়তো অনেকেই আমাকে কল্পনা-বিলাসী বা খামখেয়ালি বলিবেন। কিন্তু শহরে লালিতপালিত ব্যক্তিদের পল্লির সঙ্গে কোনোরূপ সংস্রব না থাকার ফলেই বহু প্রাচীন এবং মৌলিক জিনিসের সঙ্গেও তাহাদের পরিচয় নাই।
বিভিন্ন ঋতু ও আবাহওয়া, ফসল বোনা ও কাটা, নানা গৃহপালিত প্রাণী প্রভৃতির মানব-জীবনের সহিত সংযোগ আছে। কাজেই জীবধাত্রী বসুন্ধরার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিতে না চাহিলে ইহাদের সহিত প্রত্যেকের পরিচিত হওয়া উচিত। বিদ্যালয়ের বাহিরে নানা কাজের ভিতর দিয়া শিশুগণ এইসবের সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিতে পারে। বিদ্যালয়ের বাহিরে কাজকর্ম এবং রৌদ্রে ও মুক্ত বায়ুতে অবস্থান ছাত্রদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অশেষভাবে উপকারী; শুধু এই জন্য পল্লি অঞ্চলে ভ্রমণ বাঞ্ছনীয়। শহরের শিশুরা পল্লিতে গেলে যেইরূপ আনন্দিত হয় তাহা হইতে বোঝা যায় যে, তাহাদের একটি বড় অভাব যেন পূরণ করা হইতেছে। যতদিন এই অভাব পূরণ না হয় ততদিন শিক্ষাপ্রণালী অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।
১৪. বিদ্যালয়-জীবনের শেষ কয়েক বৎসর
আমি ধরিয়া লইয়াছি যে, পঞ্চদশ বৎসরের গ্রীষ্মের ছুটির পর যে সকল বালক-বালিকা কোনো বিষয়ে উন্নতির বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করে তাহাদিগকে ওইরূপ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হইবে। ইহাও ধরিয়া লওয়া যায় যে, এইরূপ শিক্ষার্থীর সংখ্যা হইবে অনেক। যদি কোনো শিক্ষার্থীর কোন বিষয়ের প্রতি ঝোঁক বা কোন বিষয়ের উপযুক্ত মানসিক শক্তি আছে তাহা এই সময়ের মধ্যে নিরূপণ করা সম্ভবপর না হয় তবে তাহাকে আরও কিছুদিন সাধারণ-শিক্ষাই দিতে হইবে। বিশেষ প্রতিভাবান ছাত্রের ক্ষেত্রে উন্নততর শিক্ষা পনেরো বৎসর বয়সের আগেও আরম্ভ করা যাইতে পারে। বিশেষ কারণ থাকিলে শিক্ষা ব্যাপারে এই নিয়মগুলির ব্যতিক্রম করা চলে। কিন্তু আমার মনে হয় বুদ্ধিবৃত্তিতে যাহারা সাধারণ বা মাঝারি প্রকৃতির বালক-বালিকার তুলনায় উপরের স্তরে তাহাদের চৌদ্দ বৎসর বয়সের কাছাকাছি সময়ে উন্নততর বিশেষ শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী হওয়া উচিত। যাহারা মাঝারির নিচে তাহাদের হাতের কাজ ছাড়া স্কুলে অন্য কোনো বিষয়ে উন্নততর শিক্ষা না দেওয়াই ভালো। হাতের কাজ বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্বন্ধে এখানে কিছু বলিব না। আমার মনে হয় চৌদ্দ বৎসর বয়সের পূর্বে ইহা আরম্ভ করা উচিত নহে এবং তখনও স্কুলে সর্বক্ষণ কেবল এই কাজেই ছাত্রকে নিয়োজিত রাখা সমীচীন নয়। ইহার জন্য কতখানি সময় দিতে হইবে, সকল ছাত্রকেই এইরূপ বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া উচিত কি না কিংবা কেবল অল্প সংখ্যককেই দিতে হইবে এই সকল প্রশ্ন এখানে আলোচনা করিতে চাহি না। ইহা করিতে গেলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার কথা ওঠে, সংক্ষেপে ইহা বিশদভাবে আলোচনা করা চলে না। তাহা ছাড়া শিক্ষার সঙ্গে ইহা কেবল পরোক্ষভাবে সংযুক্ত। কাজেই চৌদ্দ বৎসর বয়সের পর ছাত্রের বুদ্ধিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রেই আমার বর্তমান আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখিব।
স্কুলের পাঠ্য বিষয়গুলিকে আমি তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করিতে চাই: (১) প্রাচীন সাহিত্য, (২) অঙ্ক ও বিজ্ঞান, (৩) আধুনিক সংস্কৃতিমূলক বিষয়। আধুনিক ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্য এই তৃতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত। আমি অনুমান করিয়া লইয়াছি যে, আঠারো বৎসর বয়সের পূর্বে ছাত্রগণ বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিবে না। ইতোমধ্যে এই তিনটি বিভাগের প্রত্যেকটি বেশ খানিকটা উন্নততর বিশেষ শিক্ষাদান করা সম্ভব। যাহারা প্রাচীন সাহিত্য পড়িবে তাহারা নিশ্চয়ই লাতিন ও গ্রিক দুই ভাষাই শিখিবে। তবে কেহ হয়তো একটিতে, অপর কেহ বা অন্যটিতে বেশি অগ্রসর হইতে পারে। প্রথমে অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিক্ষা একই সঙ্গে চলিবে কিন্তু বিজ্ঞানের কতক শাখায় খুব বেশি অঙ্ক ছাড়াও দক্ষতা অর্জন করা সম্ভবপর। বস্তুত এমন কতকজন উঁচু দরের বৈজ্ঞানিক আছেন যাঁহারা অঙ্কে বিশেষ পারদর্শী নন। কাজেই ষোলো বৎসর বয়সে আমি কোনো বালক বা বালিকাকে অঙ্কে কিংবা কোনো বিজ্ঞানে বিশেষ উন্নত শিক্ষা গ্রহণ করিতে উৎসাহিত করিব, তবে সে যাহাতে অন্য বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা না করে সেইদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। আধুনিক সংস্কৃতিকমূলক বিষয়গুলি সম্পর্কেও এই অভিমত প্রযোজ্য।