এই সহানুভূতিশীল ভদ্রলোকে আত্মশোচনার কশাঘাতে জর্জরিত হইতে দেখিয়া সত্যই দুঃখ হয়। প্রেমধর্মের নীতি অনুসারেই কাজ করিতেছেন এই ধারণার বশে তিন নির্বিকার চিত্তে শিশুদের উপর বেত্রচালনা করিয়াছেন। এই ভ্রান্ত ব্যক্তির কথা চিন্তা করিলে মনে ব্যথা অনুভব করিতে হয়। কিন্তু নৈতিক অপরাধের প্রতি ঘৃণা জাগাইয়া তুলিয়া তিনি যে কত নির্দয় লোক তৈয়ার করিয়াছিলেন তাহা চিন্তা করিলে মর্মাহত হইতে হয়; মনে রাখিতে হইবে শিশুদের স্বভাবগত আলস্যও তাহার মতে নৈতিক অপরাধের অন্তর্গত। নৈতিক অন্যায়ের শাস্তিবিধানের সদিচ্ছার বশবর্তী হইয়া কত সৎ প্রকৃতির লোক যে যুদ্ধ এবং অত্যাচারের অপরাধে অপরাধী হইয়াছেন তাহা চিন্তা করিয়া শিহরিয়া উঠিতে হয়। সৌভাগ্যের কথা এই যে শিক্ষাবিদগণ এখন আর শিশুকে শয়তানের অংশ বলিয়া মনে করেন না। বয়স্ক ব্যক্তি সম্বন্ধে বিশেষত অপরাধীর শাস্তিদানকালে এই ধারণার প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্তু শিশু-নিকেতন এবং বিদ্যালয় হইতে ইহা প্রায় অন্তর্হিত হইয়াছে।
ডক্টর আর্নল্ড যে ভুল করিয়াছিলেন তাহার বিপরীত একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। ইহা কম হানিকর হইলেও বৈজ্ঞানিক দিক হইতে বিচার করিলে ভুল বটেই। ইহা হইল এই ধারণা যে শিশুরা স্বভাবত নিষ্পাপ, তাহারা কেবল তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের পাপাঁচরণ দেখিয়া দূষিত হয়। রুশোর নামের সঙ্গে এই অভিমত জড়িত। হয়তো তিনি ইহা সূত্রাকারে প্রচার করিয়াছিলেন কিন্তু তাহার এমিল [Emole] পাঠ করিলে জানা যায় যে অনেক রকমে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার পর ছাত্রটি আদর্শ শিক্ষা পদ্ধতির অভিপ্রেত সর্বগুণে ভূষিত হয়। প্রকৃত কথা হইল যে, শিশু স্বভাবতই ভালো বা মন্দ নয়। তাহারা কতকগুলি প্রতিবর্তী [Reflex] এবং প্রবৃত্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করে। পরিবেশের ফলে ইহা হইতেই স্বভাব গঠিত হয়। স্বভাব [Habit] সুস্থও হইতে পারে, অসুস্থও হইতে পারে। কিরূপ স্বভাব হইবে তাহা প্রধানত নির্ভর করে জননী অথবা ধাত্রীর জ্ঞানের উপর, কারণ শিশুর স্বভাব প্রথম অবস্থায় অত্যন্ত নমনীয় থাকে। অধিকাংশ শিশুর মধ্যেই সৎ নাগরিকের উপাদান থাকে, আবার অপরাধীর উপাদানও থাকে। বৈজ্ঞানিক মনোবিদ্যা প্রমাণ করে যে, সপ্তাহের মধ্যে ছয়দিন চাবুক এবং রবিবারের ধর্মোপদেশ প্রয়োগ করা সগুণ বিকাশের আদর্শ প্রক্রিয়া নয়। কিন্তু ইহা অনুমান করা ঠিক হইবে না যে, গুণ বিকাশের কোনো উপায় বা প্রণালী নাই। পূর্ববর্তী শিক্ষাবিদগণ শিশুদিগের উপর অত্যাচার করিয়া আনন্দ পাইতেন। সামুয়েল বাটলারের এই অভিমত উড়াইয়া দেওয়া যায় না। অন্যথায় তাহাদের অনুষ্ঠিত এইরূপ নিরর্থক অত্যাচারের সার্থকতা দেখা যায় না। একটি সুস্থ শিশুকে সুখি করা কঠিন নয়। দেহ এবং মনের যত্ন লইলে বেশিরভাগ শিশুরই সুখস্বাচ্ছন্দ্য একান্ত আবশ্যক। শিশুর যে স্বভাবগত আলস্যকে ডক্টর আর্নল্ড নৈতিক অপরাধ বলিয়া গণ্য করিতেন তাহা মোটেই থাকিবে না যদি শিশু বুঝিতে পারে যে যাহা তাহাকে শিখানো হইতেছে তাহা সত্যই এবং যাহারা শিক্ষা দিবেন তাঁহারা যদি হন নিষ্ঠুর অত্যাচারী তবে শিশু স্বভাবতই শহরের বিড়ালছানার মতো আচরণ করিবে। সুস্থ শিশুর হাঁটিবার এবং কথা বলিবার প্রয়াস হইতে বোঝা যায় তাহাদের শেখার জন্য একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা আছে। এই ইচ্ছাটাকে শিক্ষার কাজে লাগাইতে হইবে। চাবুকের স্থলে শিশুর এই স্বাভাবিক ইচ্ছার প্রবর্তন যুগের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি পরিচায়ক।
এই পুস্তকে যে আধুনিক ভাবধারার আলোচনা করিতে চাই তাহার শেষ প্রশ্নে উপনীত হইয়াছি–অধুনা বাল্যকালের উপর অধিকতর মনোযোগ দেওয়া হইতেছে আমি তাহারই উল্লেখ করিতেছি। চরিত্রের শিক্ষা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা পরিবর্তনের সঙ্গে ইহার নিবিড় যোগ আছে। প্রাচীন ধারণা ছিল ইচ্ছার উপর গুণ নির্ভর করে; মনে করা হইত যে শিশুর মন কু-ইচ্ছা দ্বারা পূর্ণ, কেবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সে ইহাদিগকে দমন করিয়া রাখে। সকল কু-ইচ্ছা সমূলে দূর করা অসম্ভব বলিয়া মনে করা হইত; শিশু কেবল ইহাদিগকে সংযত রাখিতে পারে মাত্র। এই অবস্থাকে ঠিক অপরাধী ও পুলিশের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা চলে। ভাবী অপরাধী ছাড়া যে-সমাজ চলিতে পারে তাহা কেহ অনুমান করিতে পারিত না; অধিকাংশ লোক যাহাতে শাস্তির ভয়ে অপরাধ না করে এবং অপরাধীরা ধরা পড়ে এবং শাস্তি পায় এমন গোছের তৎপর পুলিশ দল রাখিতে পারিলেই যথেষ্ট মনে করিত। বর্তমানের মনস্তাত্ত্বিক অপরাধবিজ্ঞানী কিন্তু ইহাতে সন্তুষ্ট নন। তিনি মনে করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষা দ্বারা অপরাধ করার প্রবণতা দূর করা সম্ভবপর। সমাজের পক্ষে যাহা প্রযোজ্য, ব্যক্তির কাছেও তাহা প্রযোজ্য। শিশুরা বিশেষ করিয়া তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সঙ্গীদের প্রশংসা পাইতে ইচ্ছুক হয়; তাহারা যে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে বাড়িয়া ওঠে সেই পরিবেশ অনুসারে তাহাদের প্রবৃত্তিগুলিকে ভালো বা মন্দ দিকে চালিত করা যায়। অধিকন্তু তাহাদের বয়সে অভ্যাস-গঠন করা সহজ এবং সদভ্যাস দ্বারা অনেক গুণ স্বভাবে পরিণত হইতে পারে। পক্ষান্তরে, মনের শক্তি দ্বারা কু-ইচ্ছা (অসৎ বাসনা) দমন করিয়া অসৎ আচরণ কমাইবার যে প্রক্রিয়া পূর্বে প্রচলিত ছিল তাহা মোটেই সন্তোষজনক নয়। বাঁধ দেওয়া নদীর জলের মতো অসৎ বাসনা ইচ্ছা শক্তির অজ্ঞাতসারে কোনো প্রকারে আত্মপ্রকাশ করে। যৌবনে যে যুবক পিতাকে হত্যা করার বাসনা মনে পোষণ করিত, পুত্রকে নৈতিক অন্যায়ের শাস্তি দিতেছে মনে করিয়া সে তাহাকে বেত্রাঘাত করিয়া তৃপ্তি অনুভব করে। যে সকল মতবাদ নিষ্ঠুরতা সমর্থন করে তাহাদের মূল অনুসন্ধান করিলে দেখা যাইবে, কোনো বাসনা ইচ্ছা শক্তি দ্বারা নিপীড়িত হইয়া লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল কিন্তু অবশেষে ইহাই পাপের প্রতি ঘৃণা কিংবা এমনই কোনো ভদ্র-রূপ ধারণা করিয়া সম্পূর্ণভাবে অচেনারূপে বাহির হইয়াছে। কাজেই ক্ষেত্রবিশেষে ইচ্ছাশক্তি দ্বারা পাপ-ইচ্ছার দমন প্রয়োজনীয় হইলেও গুণবিকাশের প্রণালী হিসাবে ইহা কার্যকরি নয়।