সকলেই জানেন যে, খেলার ভিতর দিয়া এইরূপ শৃঙ্খলা আয়ত্ত করা সহজ কিন্তু কেহ অনুমান করিতে পারেন নাই যে, জ্ঞান অর্জন ব্যাপারটিকেই এমন আনন্দপ্রদ করা যায় যে ইহার মধ্যেও সে ভাব সঞ্চারিত হয়। আমরা জানি যে, ইহা সম্ভব এবং কেবল শিশুর শিক্ষার বেলায় সম্ভব নয়, সকল স্তরের শিক্ষাতেই সম্ভব। আমি বলিতে চাই না যে কাজটি সহজ। নূতন প্রণালীর উদ্ভাবন করিতে প্রতিভার প্রয়োজন হইয়াছে কিন্তু সাধারণ শিক্ষকগণই ইহার প্রয়োগ করিতে পারে। ইহার জন্য প্রয়োজন সহানুভূতি, ধৈর্য এবং শিক্ষাদানের জন্য যথোপযুক্ত ট্রেনিং। মূলগত ভাবটি সরলঃ বাহির হইতে তাড়না বা জবরদস্তি করিয়া প্রকৃত শৃঙ্খলা গড়িয়া তোলা যায় না। প্রকৃত শৃঙ্খলা হইল মনের এমন একটি অভ্যাস যাহা স্বভাবতই অবাঞ্ছনীয় কার্যকলাপের দিকে না ঝুঁকিয়া বাঞ্ছনীয় কাজ ও আচরণের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শিক্ষাদান ব্যাপারে এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ সত্যিই বিস্ময়কর। ইহার জন্য সবখানি প্রশংসা মাদাম মন্তেসরির প্রাপ্য।
মূল পাপ [Original sin] সম্বন্ধে বিশ্বাস লোপ পাওয়ার ফলে শিক্ষা প্রণালীর বহুলাংশে প্রভাবান্বিত হইয়াছে। পুরাতন ধারণা ছিল শিশুমাত্রই পাপ হইতে উদ্ভূত। এরা স্বভাবতই দুষ্ট; তাহার ভিতর সদগুণের সঞ্চার করিতে ঘন ঘন শাস্তি বিধান করিতে হইবে। আমাদের পূর্বপুরুষের শিক্ষা এই ধারণা দ্বারা কিরূপ প্রভাবিত হইয়াছিল তাহা অধিকাংশ আধুনিকগণ বিশ্বাস করিতে পারিবেন না। ডিন স্ট্যানলি [Dean Stanley] লিখিত Dr. Amold-এর জীবনী হইতে উদ্ধৃত দুইটি অংশ তাহাদের ভ্রম দেখাইয়া দিবে।
ডিন স্ট্যানলি ডক্টর আর্নল্ডের প্রিয় ছাত্র ছিলেন Tom Browns School Days পুস্তকের তিনি সুবোধ বালক আর্থার। তিনি বর্তমান লেখকের খুল্লতাত ভ্রাতা; বাল্যকালে তিনি লেখককে Westminster Abbey ঘুরিয়া দেখাইয়াছিলেন। ডক্টর আর্নল্ড ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলগুলির একজন বড় সংস্কারক। এই স্কুলগুলি ইংল্যান্ডের গৌরব এবং এখনও পর্যন্ত তাহার নীতি অনুসারেই পরিচালিত হইতেছে। কাজেই ডক্টর আর্নল্ডের আলোচনা করিতে গিয়া বহু অতীতের কোনো প্রণালী বর্ণনা করিতেছি না, বর্তমানে উচ্চশ্রেণির ইংরেজদের গড়িয়া তুলিতেছে যে শিক্ষাপ্রণালী তাহারই আলোচনা করিতেছি। ডক্টর আর্নল্ড বেত মারার প্রথা হ্রাস করিয়াছিলেন। তাঁহার জীবনীকারের কথায় মিথ্যা কথা বলা, পানদোষ এবং স্বভাবত কুঁড়েমির জন্য অল্পবয়স্ক ছেলেদের মধ্যে বেত্রাঘাত প্রথা সীমাবদ্ধ রাখিয়াছিলেন। কোনো উদারনৈতিক পত্রিকা যখন মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, বেত্রাঘাত অবনতিকর শাস্তি এবং ইহা একেবারে বন্ধ করা উচিত, তখন ডক্টর আর্নল্ড অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি লিখিতভাবে উত্তর দিয়াছিলেন :
ইহা কোন ভাবের পরিচায়ক তাহা আমি জানি; ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের গর্ববোধ হইতে ইহা উদ্ভূত; ইহা যুক্তিসঙ্গত নয়, কোনো খ্রিস্টানের পক্ষে উপযুক্ত নয়, ইহা একান্তই বর্বর। শিভালরির যুগের অভিসম্পাতসহ ইহা ইউরোপে এক সময় সংক্রামিত হইয়াছিল; এখন জ্যাকোবিনিজিমের অভিসম্পাত স্বরূপ ইহা আমাদের দেশে উপস্থিত হইয়াছে।
…. যে বয়সে দোষ বা অপরাধের দরুন অপমান বোধ করিবার পুরুষোচিত অনুভূতির সন্ধান পাওয়া প্রায় অসম্ভব, তখন ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টাকে শিশুর আত্মসম্মানের পক্ষে হানিকর এইরূপ অযৌক্তিক ও হাস্যকর ধারণাকে উৎসাহ দিয়া বাড়াইয়া তোলার মধ্যে জ্ঞানের পরিচয় কোথায়? যুবকের পক্ষে যাহা অলঙ্কারস্বরূপ এবং মনুষ্যত্ব গঠনের সম্ভাবনায় যাহা পূর্ণ সরলতা, সংযম এবং মানসিক নম্রতার পক্ষে ইহার চেয়ে আর কি বেশি অপরাধী এবং প্রতিকূল হইতে পারে?
ভারতের অধিবাসীরা যদি এই মানসিক নম্রতা দেখাইতে না পারে তবে যে ডক্টর আর্নল্ডের শিষ্যের ছাত্ররা তাহাদিগকে ঠেঙাইতে উৎসাহী হইবে তাহাতে অস্বাভাবিকতা নাই।
মিঃ স্ট্রাচি Eminent Victorians পুস্তকে আরও একটি অংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন। সেটি উল্লেখ করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না। ডক্টর আর্নল্ড কোনো হ্রদের তীরে ছুটি যাপন করিতে গিয়াছিলেন। সেখানকার সৌন্দর্য দেখিয়া তাহার মনের আনন্দ কি ভাবের উদ্রেক করিয়াছিল সে সম্বন্ধে তিনি পত্নিকে বলিয়াছিলেন।
আমার চতুর্দিকে মনোরম প্রাকৃতিক শোভা দেখিয়া এবং নৈতিক অপরাধের কথা চিন্তা করিয়া স্তম্ভিত হইতে হয়। মনে হয় স্বর্গ এবং নরক যেন পরস্পর হইতে বহু দূরে নয়; যেন পাশাপাশি আমাদেরই চারিদিকে আসিয়া মিশিয়াছে। সৌন্দর্য দেখিযা মনে যেমন উল্লাস জাগিয়াছে; নৈতিক অপরাধ সম্বন্ধেও তেমনি তীব্র ভাব যদি মনে জাগিত! কেননা অন্য সব কিছুর চেয়ে নৈতিক অপরাধ সম্বন্ধেও তীব্র মনোভাবেই প্রাতকি উদ্ধারকারী ঐশ্বরিক জ্ঞান বিরাজ করে। নৈতিক সদকার্যের প্রশংসা করাই বড় কথা নয়; কিন্তু ঐরূপ কাজ না করিয়াও আমরা প্রশংসা করিতে পারি। আমরা যদি পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা করি, বিশেষ করিয়া আমাদের অন্তরস্থিত পাপকে ঘৃণা করি তবেই যিশু এবং ঈশ্বরের অনুভূতি লাভ করিতে পারি ইহাই ঈশ্বরলাভের পন্থা। হায়, ইহা দেখা এবং বলা কত সহজ এবং কাজে পালন করা এবং অনুভব করা কত কঠিন। ইহার যোগ্য কে? যে নিজের অপূর্ণতা সম্বন্ধে সচেতন এবং ইহার জন্য দুঃখ করে সে ছাড়া আর কেহ নয়। ঈশ্বর তোমাকে এবং আমাদের প্রিয় সন্তানদিগকে আশীর্বাদ করুন।