আমার অভিমত ইহা নয় যে, সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক শিক্ষা কার্যকরি শিক্ষা অপেক্ষা কম মূল্যবান। শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান, বিশ্বের ইতিহাস, সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান, কল্পনাশক্তি বাড়াইবার জন্য একান্ত আবশ্যক। কেবল কল্পনাশক্তির সাহায্যেই মানুষ ভবিষ্যতের জগৎ কেমন করিয়া গড়িতে হইবে তাহার পরিকল্পনা করিতে পারে; ইহা বাদ দিলে উন্নতি কেবল যান্ত্রিকভাবে অকিঞ্চিৎকর হইয়া পড়ে। কিন্তু বিজ্ঞানও কল্পনার উদ্রেক করিতে পারে। বাল্যকালে কোনোরকম রস উপলব্ধি করিতে না পারিলেও আমাকে বাধ্য হইয়া ইংল্যান্ড, ফান্স ও জার্মানির অনেক উৎকৃষ্ট সাহিত্য পাঠ করিতে হইয়াছে; কিন্তু ইহার চেয়ে জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূতত্ত্বই এ বিষয়ে আমার খোরাক জোগাইয়াছে। ইহা ব্যক্তিগত ব্যাপার; একজন বালক-বালিকা এক বিষয় হইতে অনুপ্রেরণা লাভ করিবে, অন্যে হয়তো অন্য বিষয় হইতে তাহা পাইবে। আমার বক্তব্য এই যে, যাহারা বিশেষজ্ঞ হইতে চায় তাহাদের কথা বাদ দিলে যেখানে কোনো বিষয় জানিতে হইলে কঠিন কৌশল আয়ত্ত করিতে হয় সেখানে শিক্ষণীয় বিষয়টি কার্যকরি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। রেনেসাঁসের যুগে আধুনিক ভাষায় খুব কম সাহিত্য ছিল। এখন হইয়াছে অনেক। যাহারা গ্রিক ভাষা জানে না তাহাদের নিকটও গ্রিক ঐতিহ্য পৌঁছাইয়া দেওয়া যায়। ল্যাটিন ঐতিহ্যের মূল্য খুব বেশি নয়। কাজেই বালক-বালিকার সাহিত্যের প্রতি বিশেষ ঝোঁক না থাকিলে সেক্ষেত্রে তাদের সংস্কৃতিমূলক শিক্ষা সংক্ষিপ্ত আকারে সহজভাবে দেওয়াই আমার ইচ্ছা; পরবর্তী বয়সে শিক্ষার কঠিন অংশটুকু আমি গণিত ও বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিতে চাই। তবে কাহারও অন্য বিষয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখা গেলে তাহার পক্ষে ওই অবস্থার ব্যতিক্রম করা হইবে। সর্বোপরি, ছাঁচে ঢালা নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থা বর্জন করিতে হইবে! কি ধরনের জ্ঞানদান করিতে হইবে এতক্ষণ আমরা এই আলোচনা করিতেছি। নৈতিক শিক্ষা এবং চরিত্রের শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্যা লইয়া এখন আলোচনা শুরু করিব। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সংস্রব নাই, মনোবিদ্যা এবং নীতিতত্ত্বই আমাদের বিবেচ্য। অল্প কিছুদিন পূর্বেও মনোবিদ্যা কেবল পুঁথিগত বিদ্যা বলিয়া বিবেচিত হইত। এ ক্ষেত্রে ইহার কোনো প্রয়োগ ছিল না। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। এখন শিল্প, মনোবিজ্ঞান, রোগীর মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান আমাদের বিশেষ বাস্তবক্ষেত্রে কাজে লাগিতেছে। আমরা আশা করিতে পারি যে, অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যায়তনে মনোবিজ্ঞান যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিবে। ইতোমধ্যেই শিক্ষার ক্ষেত্রে অনন্ত ইহা ব্যাপক এবং সুফল দান করিয়াছে।
প্রথমে শৃঙ্খলার প্রশ্নটি বিবেচনা করা যায়। শৃঙ্খলা সম্বন্ধে পুরনো ধারণা ছিল সরল ও সহজ। বালক যাহা অপছন্দ করিত তাহা তাহাকে করিতে হুকুম করা হইত কিংবা সে যাহা ভালোবাসিত তাহা হইতে বিরত হইতে আদেশ দেওয়া হইত। আদেশ অমান্য করিলে দৈহিক শাস্তি এবং গুরুতর ক্ষেত্রে কেবল জলরুটি দিয়া নির্জন কুঠুরিতে বন্দি করিয়া রাখা হইত। উদাহরণস্বরূপ The Fairchild Family পুস্তকে ছোট বালক হেনরিকে কিভাবে ল্যাটিন শিখানো হইয়াছিল তাহার বিবরণ দেখিতে পারেন। তাহাকে বলা হইয়াছিল ল্যাটিন না শিখিলে কিছুতেই ভালো ধর্মযাজক হইতে পারিবে না। কিন্তু কিছুতেই সে তাহার পিতার আগ্রহ অনুযায়ী মনোযোগ দেয় নাই। ফলে তাহাকে ছোট্ট একটি কুঠুরিতে আটক করিয়া রাখা হইল। দেওয়া হইল শুধু জল আর রুটি। তাহার ভগিনীদিগের সহিত তাহার কথা বলা নিষিদ্ধ হইল। তাহাদিগকে বলা হইল যে হেনরি ভগবানের নিকট অপরাধী হইয়াছে। ইহা সত্ত্বেও এক ভগিনী হেনরিকে গোপনে খাবার দিয়াছিল। ধরা পড়িয়া সে-ও শান্তি পাইল। কিছুকাল বন্দি থাকার পর নাকি ল্যাটিনের প্রতি হেনরির অনুরাগ জন্মে এবং ইহার পরেও অধ্যবসায় সহকারে কাজ করিতে থাকে।
ইহার বিপরীত একটি গল্প শেহর বলিয়াছেন। তাঁহার কাকা একটি বিড়ালের বাচ্চাকে ইঁদুর ধরা শিখাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহারই গল্প। যেখানে বিড়ালের বাচ্চাটি ছিল সেখানে একটি ইঁদুর লইয়া আসা হয়। কিন্তু তখনও বিড়ালের শিকার করার প্রবৃত্তি জাগ্রত হয় নাই, কাজেই সেই ইঁদুরের দিকে মনোযোগ দেয় না। ইহাতে শেহরের কাকা বিড়াল বাচ্চাটিকে প্রহার করেন। পরের দিন এই একই প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হইল। ক্রমাগত অনেক কয়দিন এইরূপ চলিতে লাগিল। অবশেষে অধ্যাপক মনে করিলেন বিড়ালটি অত্যন্ত বোকা এবং শিক্ষাদানের সম্পূর্ণ অযোগ্য। পরবর্তীকালে বিড়াল অন্যান্য বিষয়ে স্বাভাবিক হইলেও ইঁদুর দেখিলে ভয়ে কাঁপিতে থাকিত এবং ছুটিয়া পলাইত। শেহর বলিয়াছেন– বিড়াল-বাচ্চাটির মতোই আমারও কাকার নিকট হইতে ল্যাটিন শিখিবার ভাগ্য হইয়াছিল। এই দুইটি গল্প হইতে শাসনের প্রাচীন পদ্ধতি এবং ইহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিচয় পাওয়া যায়।
কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদ শৃঙ্খলা বর্জন করেন না; নূতন প্রণালীর সাহায্যে তিনি ইহা প্রবর্তন করেন। এ সম্বন্ধে যাঁহারা নূতন প্রণালীর বিষয় পড়েন নাই তাঁহারা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করিতে পারেন। পূর্বে আমার ধারণা ছিল মাদাম মন্তেসরি শৃঙ্খলার বালাই তুলিয়া দিয়াছেন। কিভাবে তিনি ঘরভরা ছেলেমেয়ে লইলা কাজ করেন ভাবিয়া আমি বিস্মিত হইতাম। তাঁহার নিজের লেখা পুস্তক পড়িয়া আমি বুঝিতে পারি শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা তিনি বিসর্জন দেন নাই, ইহা বরং তাঁহার শিক্ষাপ্রণালীর একটি বিশিষ্ট অংশ। আমার তিন বৎসর বয়স্ক ছেলেকে সকালবেলা করিয়া মন্তেসরি স্কুলে পাঠাইয়া বুঝিতে পারিলাম সে অল্প সময়ের মধ্যে নিয়মানুবর্তী হইয়া পড়িয়াছে, স্কুলের নিয়মকানুন সে হৃষ্টচিত্তেই মানিয়া চলিতেছে। ইহার জন্য কোনোরূপ বাহিরে তাগিদ বা তাড়না ছিল না; নিয়মকানুনগুলি খেলার নিয়মের; নিজেরা ইচ্ছা করিয়া কিছু শিখিতে চাহে না, ভয় দেখাইয়া জোর করিয়া তাহাদের শিখাইতে হয়। প্রমাণিত হইয়াছে যে শিক্ষাদান ব্যাপারে কৌশলের অভাবই ইহার কারণ। শিক্ষণীয় বিষয়টিকে যেমন পড়া ও লেখা–কয়েকটি সুবিধাজনক পর্যায়ে ভাগ করিয়া লইয়া প্রত্যেকটি পর্যায় শিশুর নিকট আকর্ষণীয় করা যায়। শিশুরা যখন নিজেদের পছন্দমতো কাজ করিতে সুযোগ পায়, তখন বাহির হইতে শৃঙখলা চাপাইয়া দেওয়া প্রয়োজন হয় না। কয়েকটি সরল নিয়ম সকলেই বুঝিতে পারে এবং ন্যায্য বলিয়া স্বীকার করিয়া মানিয়া চলে ইহা হইল—কোনো শিশু অন্যের খেলায় বা কাজে বাধা দিবে না। কোনো শিশুই এক সঙ্গে এক প্রস্তের বেশি খেলার সরঞ্জাম রাখিবে না। শিশু এইভাবে সদভ্যাসে অভ্যস্ত হয় এবং বুঝিতে পারে যে কোনো ভালো ফল লাভ করিতে হইলে অনেক সময়ে প্রবৃত্তিকে দমন করা আবশ্যক। এইভাবে শিশু আত্মসংযম বা আত্মশৃঙ্খলা অর্জন করে।