দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য অপেক্ষা মানসিক সম্পদেরই যে মূল্য বেশি শুধু একথা দ্বারা এ দাবি ঠেকানো যাইবে না। এ কথার ভিতর সত্যতা আছে কিন্তু ইহাই সবখানি সত্য নয়। কারণ দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্যের মূল খুব বেশি না হইলেও ইহার অভাব দেহধারণের জন্য যাহা প্রয়োজন তাহার অভাব–মানুষের মানসিক গুণরাশি নষ্ট করিয়া ফেলিতে পারে। যখন হইতে মানুষ দূরদৃষ্টি লাভ করিয়াছেন, তখন হইতেই খাদ্যাভাব, রোগ এবং ইহাদের চিরজাগরুক ভীতি বহু মানুষের উপর আশঙ্কার ছায়াপাত করিয়াছে। খাদ্যের অভাবে বহু পাখি মরিয়া যায় কিন্তু ইহাদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা নাই বলিয়া যখন খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে তখন ইহারা সুখি। যে সকল কৃষক একবার দুর্ভিক্ষ কাটাইয়া উঠিয়াছে তাহারা খাদ্যাভাবের ভীতিজনক-স্মৃতি কিছুতেই মন হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারে না।
মৃত্যুবরণ করার চেয়ে মানুষ বরং সামান্য অর্থের জন্যও বহুক্ষণ পরিশ্রম করিতে ইচ্ছুক কিন্তু ইতর প্রাণী কোনো সাময়িক সুখের মূল্যস্বরূপ মৃত্যুবরণ করিতে হইলেও ক্ষণস্থায়ী সুখই পছন্দ করে। তাই দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই প্রায় নিরানন্দ জীবন-যাপন করে; কারণ সুখের আশায় অন্য কোনো প্রকারে জীবন-যাপন করিতে গেলে জীবনকাল হইবে সংক্ষিপ্ত। শিল্পবিপ্লবের দৌলতে বর্তমান যুগে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সকল মানুষের জন্য অনন্ত কিছু পরিমাণে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিধান করা সম্ভবপর। আমরা ইচ্ছা করিলে মানুষের দৈহিক দুঃখের কিছুটা লাঘব করিতে পারি। বিজ্ঞানের সাহায্যে এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা দ্বারা পৃথিবীর সকল মানুষের খাদ্য এবং বাসগৃহের বন্দোবস্ত করিয়া বিলাসিতার মধ্যে না হউক, মোটামুটিভাবে বাঁচিবার ব্যবস্থা করা যায়। রোগ নিবারণ করা এবং স্বাস্থ্যহীনতা দূর করা সম্ভব হইতে পারে; জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা রাখিয়া খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেশি করা চলিতে পারে; মানুষের অবচেতন মন হইতে নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার এবং যুদ্ধের ভীতি দূর করা যাইতে পারে। মানুষের জীবনে এ সবের এত প্রয়োজন যে, যে-শিক্ষার দ্বারা ইহা লাভ করা সম্ভবপর তাহার বিরোধিতা করা চলে না। এরূপ শিক্ষার ফলিত বিজ্ঞান প্রাধান্য লাভ করিবে। পদার্থবিদ্যা, শারীরবিদ্যা এবং মনোবিজ্ঞান ছাড়া আমরা নূতন জগৎ গড়িতে পারি না; বরং ল্যাটিন ও গ্রিক সাহিত্য দান্তে এবং শেক্সপিয়র, ব্যাক এবং মোজার্ট ছাড়া চলিতে পারে। কার্যকরি শিক্ষার স্বপক্ষে ইহাই একটি বড় যুক্তি। বিশেষভাবে অনুভব করি বলিয়াই আমি ইহা জোরের সঙ্গে উল্লেখ করিতেছি। তথাপি এ প্রশ্নের অন্য একটি দিকও আছে। যদি অবসর এবং স্বাস্থ্য ভালোভাবে কাজে লাগানোর উপায় জানা না থাকে তবে এগুলি অর্জনের সার্থকতা কোথায়? অন্যান্য ক্ষেত্রে যুদ্ধের মতোই মানুষের দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে অভিযান এমন কঠোরভাবে চালানো উচিত নয় যাহাতে শান্তির সময় অবসর বিনোদনের শিক্ষা ব্যাহত হয়, জগতের কল্যাণকর সামর্থ্যটুকু যেন সবখানিই কেবল দুঃখ-কষ্ট জয় করার সংগ্রামে ব্যয়িত না হয়।
আমরা এখন বিতর্কের বিষয়ীভূত তৃতীয় পক্ষে উপনীত হইয়াছি। ইহা কি সত্য যে কেবল অকেজো শিক্ষাই প্রকৃতপক্ষে মূল্যবান? ইহা কি সত্য যে যে কোনো মূল্যবান শিক্ষাই অকেজো? আমার নিজের কথা বলিতে পারি, আমি যৌবনের অনেকখানি সময় ল্যাটিন ও গ্রিক শিক্ষায় অতিবাহিত করিয়াছি। এখন মনে হয় সে-সময়ের অপচয় হইয়াছে। পরবর্তী জীবনে আমি যে-সব সমস্যার সম্মুখিন হইয়াছি গ্রিক ও ল্যাটিন শিক্ষা আমাকে তাহা সমাধান করিতে কোনো হায়তা করে নাই। যাহারা প্রাচীন-সাহিত্য পড়ে তাহাদের শতকরা ৯৯ জনের মতোই আমি ওইসব ভাষায় এমন যোগ্যতা অর্জন করি নাই যাহাতে সে-ভাষায় সাহিত্য পাঠ করিয়া আনন্দ লাভ করিতে পারি।
পক্ষান্তরে গণিত ও বিজ্ঞানের যাহা কিছু আমি শিখিয়াছিলাম তাহা কেবল অবশেষ কাজেই লাগে নাই, চিন্তার বিষয়বস্তু এবং এই প্রবঞ্চনাময় সংসারে সত্যের কষ্টিপাথর হিসাবেও তাহাদের মূল্য অপরিসীম। ইহা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত খেয়াল হইতে পারে কিন্তু আমার বিশ্বাস এই যে, প্রাচীন সাহিত্য পাঠ দ্বারা উপকৃত হইতে পারেন এরূপ খেয়ালযুক্ত লোকের সংখ্যা আধুনিকদের মধ্যে খুবই কম। ফ্রান্স ও জার্মানিরও উন্নত সাহিত্য আছে; তাহাদের ভাষা সহজেই শিক্ষা করা যায় এবং অনেক প্রকারে ব্যবহারিক কাজেও লাগে। কাজেই ল্যাটিন ও গ্রিক সাহিত্যের চেয়ে ফরাসি ও জার্মানি সাহিত্যের পক্ষে বলিবার অনেক কিছু আছে। যাহা কিছু, সাক্ষাভাবে কার্যকরি নয়, এরূপ শিক্ষার গুরুত্ব না কমাইয়াও দাবি করা চলে যে, বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যদের বেলায় ব্যাকরণের খুঁটিনাটি ও মারপ্যাঁচ বাদ দিয়া শিক্ষা দেওয়া উচিত। মানুষের জ্ঞানের পরিমাণ এবং মানবীয় সমস্যার জটিলতা দিন-দিনই বাড়িতেছে। কাজেই নূতনকে গ্রহণ করিতে হইলে প্রত্যেক প্রজন্মেই [Generation-এ] শিক্ষাব্যবস্থা ঢালিয়া সাজাইতে হইবে। নূতন এবং পুরাতনের মধ্যে বোঝাঁপড়া ও সামঞ্জস্যের সাহায্যে সমতা রক্ষা করিতে হইবে। সাহিত্য সম্বন্ধীয় উপাদান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই থাকিবে তবে তাহাদের জটিলতা কমাইয়া এমন করিতে হইবে যেন আধুনিক যুগ সৃষ্টি করিয়াছে যে-বিজ্ঞান তাহা শিক্ষার জন্য যথেষ্ট সময় ও সুযোগ থাকে।