কোনো কিছু সৃষ্টি করা এবং কোনো কিছু ভাঙিয়া ফেলা উভয়ই ক্ষমতা প্রকাশের বাসনাকে তৃপ্ত করে কিন্তু ভাঙিয়া ফেলার তুলনায় সৃষ্টি করা কঠিনতর। কাজেই ধ্বংস করা অপেক্ষা সৃষ্টিতে আনন্দ বেশি। সৃজন বা ধ্বংস বলিতে কি বুঝায় তাহার পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করিব না।
মনোবিজ্ঞানের কথায় বলা যায় আমরা যখন পূর্বপরিকল্পিত গড়ন অনুযায়ী কিছু তৈয়ার করি তখনই সৃষ্টি করি; নূতন কোনো আকার দিবার পরিকল্পনা না রাখিয়া আমরা যখন কোনও বর্তমান জিনিসের পরিবর্তন সাধন করি তখনই ধ্বংস করা হইল। এ ব্যাখ্যার সম্বন্ধে যাহাই মনে করা হউক না কেন কোনো কাজ গঠনমূলক কি না কার্যক্ষেত্রে তাহা আমরা সকলেই বুঝিতে পারি। তবে ইহারও ব্যতিক্রম আছে; কোনো লোক যখন বলে যে নূতন সৃষ্টির জন্যই সে ধ্বংস করিতেছে তখন তাহার আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকিলে তাহার কাজ সৃষ্টিকার্য কি ধ্বংসকার্য তাহা নির্ণয় করা সত্যই কঠিন।
সৃষ্টি অপেক্ষা ধ্বংস করা সহজ; এ জন্য ধ্বংস করা অর্থাৎ কোনো কিছু ভাঙিয়া ফেলা হইতে শিশুর সূত্রপাত হয়। বালির মধ্যে খেলা করিবার সময় শিশুরা চায় বয়স্ক ব্যক্তিরা কেহ বাটি দিয়া ছোট ছোট পিঠার মতো টিবি তৈয়ার করিয়াদিক; তারপর তাহারা সেইগুলি ভাঙিয়া ফেলিতে আনন্দ পায়। কিন্তু যখন তাহারা নিজেরা এইরূপ তৈয়ার করিতে শেখে তখন ইহা প্রস্তুত করিতেই তাহাদের আনন্দ; তখন তাহারা কাহাকেও সেইগুলি ভাঙিয়া ফেলিতে দিতে চায় না। শিশুরা যখন প্রথম ইট লইয়া খেলা করে তখন তাহারা তাহাদের অপেক্ষা বয়সে বড় সঙ্গীদের নির্মিত ইটের খেলার ঘরবাড়ি ভাঙিয়া ফেলিতে ভালোবাসে। কিন্তু তাহারা নিজেরা ইট দিয়া কোনো কিছু তৈয়ার করিতে পারিলে নিজেদের কাজের জন্য রীতিমত গর্ব বোধ করে এবং কেহ যে তাহাদের সাধের সৌধ ভাঙিয়া দিবে তাহা তাহারা সহ্য করিতে পারে না। যে আবেগের ফলে শিশু এই খেলার আনন্দ পায় তাহা ভাঙা এবং গড়া উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে বিদ্যমান আছে। নূতন কৌশল কেবল খেলার আবেগ পরিতৃপ্ত করার পরিবর্তন আনিয়াছে। ভাঙিতে শিশুর যেইরূপ, গড়িতেও সেইরূপ আনন্দ। গড়িবার কৌশল শিক্ষার পর শিশু ভাঙা অপেক্ষা গড়াই বেশি পছন্দ করে। দেখা যায় যে শিশু পূর্বে কেবল ভাঙিয়া ফেলিয়াই আনন্দ পাইত, সেই পরে গড়িতেই বেশি আনন্দ পাইতেছে।
শিশু যেমন প্রথম সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করে তখন তাহার মধ্যে অনেকগুলি গুণের বিকাশ ঘটানো যায়। শিশু যখন তাহার নিজের তৈরি জিনিস নষ্ট না করিতে অনুরোধ করে তখন তাহাকে সহজেই বুঝাইতে পারেন যে, সে নিজেও যেন অন্যের কোনো জিনিস নষ্ট না করে। এইভাবে আপনি শিশুর মনে অপরের পরিশ্রম দ্বারা উৎপাদিত জিনিসের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাইয়া তুলিতে পারেন। পরিশ্রমই ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের পক্ষে সমাজের দিক হইতে একমাত্র নির্দোষ উপায়। সৃজন কার্যের উৎসাহ দান করিতে আপনি শিশুর ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উৎসাহ দিন; এ গুণগুলি ছাড়া সে যতখানি উঁচু চুড়া তৈয়ার করিতে চায় ততখানি পারিবে না। শিশুদের সঙ্গে খেলায় যোগদান করিয়া আপনি এমনভাবে কোনো কিছু তৈয়ার করুন যাহাতে তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়; আপনি কেবল দেখাইয়া দিন কিভাবে তৈয়ার করিতে হয়, তারপর শিশুদের উপরই তৈয়ার করিবার ভার ছাড়িয়া দিন।
শিশুকে বাগানে প্রবেশ করিতে দিলে তাহার সৃষ্টির বাসনাকে নূতন আকারে ভালোভাবে বর্ধিত করা যায়। বাগানে ঢুকিলেই সুন্দর আকর্ষণীয় ফুলগুলি তোলাই হইবে তাহার প্রথম আবেগ। নিষেধ করিয়া তাহাকে নিবৃত্ত করা যায় কিন্তু শিক্ষা হিসাবে শুধু নিষেধই যথেষ্ট নয়, যে শ্রদ্ধাযুক্ত মনোভাবের ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা বাগানের ফুল যথেচ্ছভাবে নষ্ট করে না, সেইরূপ মনোভাব শিশুর মধ্যেও জাগাইয়া তুলিতে হইবে। সুন্দর এবং নয়নানন্দদায়ক কিছু তৈয়ার করিতে কি পরিমাণ পরিশ্রম ও চেষ্টার দরকার তাহা উপলব্ধি করিতে পারে বলিয়াই বয়স্ক ব্যক্তিদের মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগে। শিশুর বয়স যখন তিন বৎসর হইবে তখনই তাহাকে বাগানের মধ্যে এক কোণে কিছুটা জায়গায় ফুলগাছের চারা লাগাইতে উৎসাহিত করা যায়। গাছগুলি বড় হইয়া ফুল ফুটিলে তখন সেইগুলি তাহার কাছে অপূর্ব এবং মহামূল্যবান বলিয়া মনে হইবে। তাহার ফুল কেহ নষ্ট করুক ইহা যেমন সে চাহিবে না, তেমনই সে বুঝিতে পারিবে যে তাহার মায়ের ফুলগুলির প্রতিও অনুরূপ যত্ন লওয়া উচিত।
গঠনমূলক কাজ ও জীবন্ত প্রাণীর প্রতি প্রীতি এবং অনুরাগ বৃদ্ধি করিয়া শিশুর নিষ্ঠুরতা দূর করা যায়। প্রায় সকল শিশুই একটু বড় হইলেই মাছি এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গ মারিতে চায়। এই অভ্যাস ক্রমে বড় প্রাণী এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ হত্যা করার অভিলাষ জন্মায়। ইংল্যান্ডে সাধারণ সম্ভ্রান্ত পরিবারে পাখি হত্যা করা বিশেষ প্রশংসনীয় কাজ বলিয়া পরিগণিত; যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ হত্যা তো তাহাদের নিকট একটি মহান কাজ। এই সকল কাজ অসংস্কৃত প্রবৃত্তির প্রেরণাসঞ্জাত। যে সকল লোক কোনো প্রকার গঠনমূলক কৌশল জানে না এবং যাহারা ক্ষমতা প্রকাশের বাসনাকে অন্য কোনো নির্দোষ শান্তিপূর্ণ উপায় পূর্ণ করিতে পারে না, তাহারাই নৃশংস আচরণের ভিতর দিয়া ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া থাকে। তাহারা সুন্দর পাখি হত্যা করিতে পারে, রায়ত প্রজাদিগের উপর অত্যাচার করিতে পারে; প্রয়োজন হইলে তাহারা একটি গণ্ডার অথবা একজন জার্মানকে বিনা দ্বিধায় গুলি করিয়া মারিতে পারে। কিন্তু তাহাদের পিতামাতা ও শিক্ষকগণ শিক্ষা দিয়া তাহাদিগকে শুধু ইংরেজ ভদ্রলোকে পরিণত করিয়াছেন; অন্যান্য অধিকতর প্রয়োজনীয় শিল্পকাজে তাহারা সম্পূর্ণ অপারগ। আমি বিশ্বাস করি না যে জন্মের সময় তাহারা অন্যান্য শিশু অপেক্ষা অধিকতর মূর্খ ছিল; পরবর্তীকালে তাহাদের চরিত্রের ত্রুটিগুলির জন্য একমাত্র কুশিক্ষাই দায়ী। যদি বাল্যকাল হইতে তাহারা প্রাণী পুষিয়া যত্নের সঙ্গে তাহাদের বৃদ্ধি লক্ষ করিত এবং জীবনের মূল্য উপলব্ধি করিত, যদি তাহারা সৃজন কৌশল আয়ত্ত করিত, যদি তাহারা বুঝিত যে কোনো ভালো জিনিস তৈয়ার করিতে কত যত্ন পরিশ্রম এবং অনুরাগ দরকার কিন্তু নষ্ট করা যায় এক মুহূর্তেই, তবে অন্যের উৎপাদিত বা লালিতপালিত কোনো কিছু অনায়াসে ধ্বংস করিতে উদ্যোগী হইত না। যদি অপত্যস্নেহ জাগ্রত হয় পিতৃত্ব এ বিষয়ে বড় শিক্ষকের কাজ করে। [পিতৃ-হৃদয়ে সন্তানের প্রতি স্নেহ সঞ্চার হইলে তাহা মানুষের মন কোমল এবং অপরের সন্তানের প্রতি মমতাশীল করে। অপত্যস্নেহ মানুষের হৃদয়ের কঠোরতা দূর করিয়া করুণা ও ক্ষমা গুণে তাহাকে মহত্তর করে। কিন্তু ধনীদের মধ্যে কদাচিৎ এইরূপ ঘটে কেননা সন্তানের লালন পালনের ভার তাহারা বেতনভূক পরিচারিকাদের হস্তে ছাড়িয়া দেয়। সন্তানকে নিজেদের স্নেহরসে পুষ্ট করিবার বা সন্তানের প্রতি বাৎসল্য-প্রীতি জাগ্রত করার ও প্রয়োগ করার তাহাদের অবসর কোথায়? কাজেই এইরূপ পরিবারের শিশুরা পিতৃত্বে উপনীত হওয়ার পরও যে ধ্বংসমনোবৃত্তি পরিত্যাগ করিবে সেইরূপ আশা নাই। বাল্যকাল হইতেই জীবনের মূল্যবোধ এবং জীবনের প্রতি দরদ সঞ্চার করিয়া শিশুর মন হইতে নিষ্ঠুরতা দূর করিতে হইবে।