স্কুলের খেলাধুলার আরও একটি দিকে আছে; সাধারণত এটি ভালো বলিয়াই বিবেচিত হয় কিন্তু আমার মতে ইহার ফল মোটের উপর ভালো নয়। খেলার ভিতর দিয়া সংঘ-প্রীতি বা দলের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করার কথাই এখানে বলিতেছি। কর্তৃপক্ষ এই সংঘ-প্রীতি পছন্দ করেন, কেননা ইহার সাহায্যে খারাপ উদ্দেশ্যকেও তথাকথিত ভালো কাজে লাগানো যায়। ছাত্রদের কাজে উৎসাহ দিতে হইলে অন্য এক দলকে প্রতিযোগিতায় পরাভূত করার বাসনা জাগাইয়া তুলিলেই কাজ সহজ হয়। ইহার অসুবিধা হইল এই যে, যাহাতে প্রতিযোগিতা নাই সেইরূপ কাজে উদ্যম আসে না। আমাদের সকল কাজেই প্রতিযোগিতার মনোভাব কতদূর প্রসারিত হইয়াছে তাহা চিন্তা করিলে বিস্মিত হইতে হয়। আপনি যদি আপনার নিজের জেলার শিক্ষা মঙ্গল সমিতির সেবাকার্য আরও ভালো করিতে চান আপনাকে উল্লেখ করিতে হইবে যে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে শিশু-মৃত্যুর হার অনেক কম। কোনো শিল্পোৎপাদনকারীকে যদি কোনো নূতন প্রকৃত পন্থা গ্রহণ করিতে বলেন তবে আপনাকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইহা দ্বারা কিরূপ সুবিধা হইবে তাহা দেখাইয়া দিতে হইবে। প্রতিযোগিতা ভিন্ন। কোনো নির্মাণ ক্ষমতার বা গঠন কৌশলের উন্নতির চেষ্টা হয় না; অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার চিন্তা বাদ দিয়া লোকে কেবল উন্নতির জন্যই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয় না। আমাদের স্কুলের খেলাধুলার তুলনায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গেই ইহার বেশি সম্বন্ধ। কিন্তু বর্তমানে স্কুলের অনুষ্ঠিত খেলাধূলার মধ্যে প্রতিযাগিতার ভাব বিদ্যমান রহিয়াছে। যদি প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার মনোভাব প্রবর্তন করিতে হয় তবে স্কুলের খেলাধুলায় এর পরিবর্তন আবশ্যক হইবে। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করিতে হইলে আমাদের নির্ধারিত বিষয়বস্তু ছাড়া অন্য বিষয়ের অবতারণা করিতে হয়। আমরা এখানে ভালো রাষ্ট্র গঠনের বিষয় আলোচনা করিতেছি না, বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতরেই ভালো নাগরিক সৃষ্টি করার উপায়ই এ পুস্তকের আলোচ্য বিষয়। নাগরিকের ব্যক্তিগত উন্নতি এবং সমাজের উন্নতি পাশাপাশি চলা উচিত কিন্তু শিক্ষা প্রসঙ্গে লেখকের নিকট ব্যক্তি ও তাহার যথোপযুক্ত বিকাশ সাধনই প্রধান।
০৬. সৃজন কার্য
খেলার আলোচনা প্রসঙ্গে এ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে উল্লিখিত হইয়াছে। এখন কিঞ্চিৎ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইবে।
আমরা দেখিয়াছি, শিশুদের প্রবৃত্তিজাত বাসনাগুলি প্রথমে কোনো নির্দিষ্ট আকারে থাকে না; শিক্ষা এবং সুযোগ তাহাদিগকে বিভিন্ন আকার দিয়া বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। আদি পাপ সম্বন্ধে পুরাতন ধারণা কিংবা স্বভাবতই শিশু নিষ্পাপ এবং সকল গুণের আধার বলিয়া রুশোর বিশ্বাস ইহার কোনোটাই সত্য নয়। কিতক লোকের ধারণা ছিল, শিশু মানুষের পাপ হইতে জাত, তাহার ভিতরেও পাপের বীজ রহিয়াছে এবং কালক্রমে তাহা বিকাশ লাভ করিবে; পাপ হইতে জাত তাহা কখনোই আপনা আপনি ভালো হইতে পারে না। রুশো ঠিক ইহার বিপরীত বিশ্বাস প্রচার করিয়াছেন। তাহার মতে শিশু নিষ্কলুষ এবং সকল গুণের সম্ভাবনা তাহার মধ্যে সুপ্ত রহিয়াছে।] কাঁচামালের মতো শিশুর প্রবৃত্তি নিরপেক্ষ থাকে; পরিবেশের প্রভাবে ইহা ভালো বা মন্দ আকার গ্রহণ করে। এরূপ বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে কতকগুলি অস্বাভাবিক ক্ষেত্র ছাড়া অধিকাংশ লোকের প্রবৃত্তিগুলি এমন থাকে যে তাহাদিগকে ভালোর দিকেই বিকশিত করা যায়; শিশুর অল্প বয়স হইতেই যদি তাহার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন লওয়া যায় তবে মনোরোগীর সংখ্যা খুব অল্পই হইবে। উপযুক্ত শিক্ষার ফলে মানুষ তাহার প্রবৃত্তি অনুসারে আচরণ করিয়া জীবনধারণ করিতে পারে; প্রবৃত্তি হইতে শিশু অমার্জিত নির্দিষ্ট আকারবিহীন, উদ্দাম প্রবৃত্তি লাভ করে। শিক্ষার ফলে ইহাই হয় সুসংযত, সুষ্ঠুভাবে বিকশিত। আদিম ও অসংস্কৃত প্রবৃত্তি দ্বারা নয়, উপযুক্ত শিক্ষার ফলে মানুষের প্রবৃত্তি যখন সুনিয়ন্ত্রিত হয় তখনই ইহা দ্বারা পরিচালিত হইয়া সে ভাবে জীবনযাপন করিতে পারে। কোনো বিষয়ে দক্ষতা বা কৌশল মানুষের প্রবৃত্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে বিকশিত করার একটি প্রধান উপায়, এই কৌশল কোনো নির্দিষ্ট প্রকারের তৃপ্তি দান করে; মানুষকে কোনো যথাযথ রকমের কৌশল শিখাইলে কিংবা কোনো প্রকার কৌশলই না শিখাইলে সে হইবে পাপী। শিশুর প্রবৃত্তিগুলিকে প্রথম অবস্থায় মনে করা যায় কাঁচামালের মতো। শিল্পী যেমন কাঁচামালকে তাহার সামর্থ্য ও অভিরুচি অনুসারে সুন্দর অথবা অসুন্দর দ্রব্যে পরিণত করে, তেমনই শিশুর প্রবৃত্তিগুলি যেরূপভাবে নিয়ন্ত্রিত ও বিকাশপ্রাপ্ত হয় তাহার উপরই নির্ভর করে শিশু কিরূপ বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হইবে।
এই সাধারণ নিয়ম শিশুর ক্ষমতা অর্জনের বাসনার প্রতি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আমরা কোনো কিছু করিতে চাই; এইরূপ কাজের ভিতর দিয়া ক্ষমতার প্রকাশ দেখানই উদ্দেশ্য। কি ধরনের কাজের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রকাশ করা হইবে সে সম্বন্ধে প্রথমে কোনো লক্ষ্য থাকে না। মোটামুটিভাবেই বলা যায়, কাজ যত কঠিন হইবে ইহা সম্পন্ন করার আনন্দও তত বেশি হইবে। মানুষ পাখির মতো ডানা মেলিয়া উড়িতে চায়, কারণ ইহা কঠিন কাজ; শিকারি উপবিষ্ট পাখিকে গুলি করিয়া মারিতে বিশেষ আনন্দ পায় না। কেননা ইহা সহজ কাজ। উদাহরণস্বরূপ ইহাদের কথা উল্লেখ করা হইল। আকাশে ওড়া বা গুলি করিয়া পাখি মারা কাজ সম্পন্ন করিতে যে পদ্ধতি কঠিন বা অসাধারণ তাহাই বেশি আনন্দ দেয়। অন্যত্রও এই নীতি প্রয়োগ করা চলে। জ্যামিতি শেখার আগে পর্যন্ত আমি গণিত পছন্দ করিতাম, বিশ্লেষণমূলক [Analytical Geometry] জ্যামিতি শেখার পূর্বে পর্যন্ত জ্যামিতি ভালো লাগিত। এইভাবে একটি আয়ত্ত করার পর কঠিনটির দিকে ক্রমশ ঔৎসুক্য অগ্রসর হইতে থাকে। শিশু প্রথমে হাঁটিতেই আনন্দ পায়, পরে দৌড়াইতে, তাহার পর লাফাইতে এবং কোনো কিছু বাহিয়া উপরে উঠিতে সে ভালোবাসে। যাহা আমরা সহজে করিতে পারি তাহার মধ্যে আর শক্তির প্রকাশ অনুভব করি না। নূতন কৌশল অথবা যাহা আয়ত্ত করা সম্ভব হইবে কি না সন্দেহ আছে তাহা আয়ত্ত করিতে পারিলে কৃতকার্য হওয়ার তীব্র আনন্দানুভূতি লাভ হয়। কাজেই দেখা যায় ক্ষমতা লাভের বাসনাকে যে-কোনো প্রকার কৌশল আয়ত্ত করার সঙ্গেই খাপ খাওয়াইয়া লওয়া চলে।