শৈশবের খেলার সঙ্গে পরবর্তীকালের খেলার পার্থক্য এই যে, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খেলাও ক্রমে বেশি প্রতিযোগিতামূলক হইয়া উঠে। প্রথমে শিশু একা একা নির্জনে খেলিতে ভালোবাসে; বড় ভাইবোনের সঙ্গে মিলিয়া খেলিবার সামর্থ্য তখন তাহার থাকে না। কিন্তু সে যখন অন্যের সঙ্গে একত্রে খেলিলে আনন্দ পায় তখন একাকী খেলা আর তাহার নিকট পছন্দ হয় না। ইংরেজ অভিজাত সম্প্রদায় স্কুলের খেলাধুলার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। যদিও খেলার কতকগুলি উপকারিতা আছে তবুও আমার মনে হয় ইংরেজরা ক্রীড়াকৌশলকে যেরূপ প্রাধান্য দিয়াছে তাহাতে যেন কিঞ্চিৎ আতিশয্য ঘটিয়াছে। খেলাধূলায় যদি চরম উৎকর্ষের দিকে ঝোঁক দেওয়া না হয় তবে ইহা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী সন্দেহ নাই। যদি খেলায় নিপুণতা প্রদর্শনীই উদ্দেশ্য হয় তবে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়গণ বাড়াবাড়ি করে এবং অপর সকলে দর্শকে পরিণত হয়। যাহারা ভালো খেলা জানে তাহারা আরও উৎকর্ষ লাভ করিবার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করে, সাধারণ খেলোয়াড়গণ প্রতিযোগিতা হইতে দূরে সরিয়া শুধু অপরের ক্রীড়াকৌশল দেখে, তাহাদের নিজেদের স্বাস্থ্যচর্চা আশানুরূপ হয় না। খেলার একটি গুণ এই যে ইহা বালক-বালিকাদিগকে হইচই না করিয়া আঘাত সহ্য করিতে এবং প্রফুল্লচিত্তে কঠোর পরিশ্রম করিতে শিক্ষা দেয়। খেলার অন্যান্য উপকারিতা সম্বন্ধে যাহা বলা হয় তাহার বেশিরভাগই আমার কাছে কাল্পনিক বলিয়া মনে হয়। বলা হয় যে, খেলা সহযোগিতা শিক্ষা দেয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বালক-বালিকা উহা প্রতিযোগিতার আকারেই শিক্ষা করে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা শিল্পে বা যথাযথ রূপ সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নয়, ইহার প্রয়োজন যুদ্ধে। বিজ্ঞানের কল্যাণে অর্থনীতিতে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রতিযোগিতার স্থান গ্রহণ করিতে সক্ষম হইয়াছে; বিজ্ঞানের কল্যাণেই প্রতিযোগিতা (যেমন যুদ্ধবিগ্রহ) পূর্বের অপেক্ষা অনেক বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করিয়াছে। সে জন্য যে প্রতিযোগিতামূলক কার্যকলাপে মানুষে মানুষে সংঘাত বাঁধে, যাহাতে একদল মানুষ হয় জয়ী, অপর দল হয় পরাজিত তাহার পরিবর্তে এমন সহযোগিতামূলক কর্মপ্রচেষ্টায় উৎসাহ দেওয়া উচিত যাহাতে সেখানে বহিঃপ্রকৃতিকে শত্রু বলিয়া গণ্য করিয়া মানুষ তাহার উপর আধিপত্য লাভ করিতে পারে। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা না করিয়া পরস্পরের সহযোগিতায় মানুষ প্রকতিকে জয় করিতে যত্নবান হউক ইহাই কাম্য। এই বিষয়ের উপর আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না, কেননা প্রতিযোগিতার মনোভাব মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক এবং ইহা প্রকাশের কোনো পথও থাকা দরকার; আর খেলাধুলায় ও দেহচর্চায় দ্বন্দ্বের মতো নির্দোষ প্রতিযোগিতাও বিশেষ কিছু নাই। খেলা বন্ধ না করার পক্ষে ইহা যুক্তিপূর্ণ কারণ সন্দেহ নাই কিন্তু এই কারণে স্কুলের পাঠ্যতালিকায় ইহাকে প্রধান স্থান দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। বালকেরা খেলা পছন্দ করে, কাজেই তাহাদিগকে খেলিতে দেওয়া উচিত; জাপানিরা যাহাকে বলে বিপজ্জনক চিন্তা তাহা হইতে বালকদিগকে মুক্ত রাখিবার উদ্দেশ্যে বিপজ্জনক চিন্তার প্রতিষেধকরূপে কর্তৃপক্ষ দ্বারা খেলার প্রবর্তন ও প্রয়োগ সমর্থন করা চলে না।
পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে ভয়কে জয় করা এবং সাহস প্রদর্শনের উপযোগিতা আলোচনা করা হইয়াছে। মনে রাখিতে হইবে সাহস এবং নির্দয়তা [Brutality] এক জিনিস নয়। একজনের ইচ্ছা জোর করিয়া অন্যের উপর চাপাইয়া যে আনন্দ তাহাই নির্দয়তা; ব্যক্তিগত বিপদ উপেক্ষা করার মধ্যে দেখা যায় সাহস। সুযোগ পাওয়া গেলে আমি বালক-বালিকাদিগকে ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রে ছোট জাহাজ চালানো, উচ্চস্থান হইতে জলে ঝাপানো, মোটর গাড়ি চালানো, এমনকি বিমান চালনা শিক্ষা দিতে চাই। আউন্ডলের [Sanderson of Oundle] স্যান্ডারসন যেমন করিয়াছিলেন আমিও তেমনি কিশোর-কিশোরীকে যন্ত্র তৈয়ার করিতে এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার বিপদের সম্মুখিন হইতে শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী। যতদূর সম্ভব খেলাধুলায় জড় প্রকৃতিকে আমি মানুষের প্রতিপক্ষরূপে বিচেনা করিতে চাই; জড় প্রকৃতির সহিত দ্বন্দ্বেও বালকের ক্ষমতালাভের বাসনা পরিতৃপ্ত হইবে, যেমন হয় অপর মানুষের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এই উপায়ে যে কৌশল অধিগত হয় তাহা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার কৌশল অপেক্ষা বেশি প্রয়োজনীয় এবং যে চরিত্র গঠিত হয় তাহা সামাজিক নীতির সহিত বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। নৈতিক গুণগুলি ছাড়াও দেহচর্চার উপর অতিরিক্ত ঝোঁক দেওয়ার ফলে বুদ্ধিবৃত্তি ম্লান হইয়া পড়ে। মূর্খতা হেতু এবং কর্তৃপক্ষ বুদ্ধির বেশি মূল্য দেন না কিংবা ইহা বিকাশের উপর গুরুত্ব দেন না। এইজন্য গ্রেট ব্রিটেন শিল্পজগতে তাহার অধিকার হারাইতেছে, হয়তো সাম্রাজ্যও হারাইবে। এই সবই খেলাধুলার উপকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অতিরিক্ত গোঁড়া বিশ্বাসের ফল। ইহার আরও গভীরতর দিক আছে : বর্তমানের জটিল সমস্যাসঙ্কুল জগৎকে বুঝিতে হইলে জ্ঞান এবং চিন্তার বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু খেলাধুলার যোগ্যতাই কোনো যুবকের গুণপনার একমাত্র মাপকাঠি, এই বিশ্বাস যেখানে প্রবল সেখানে বুঝিতে হইবে যে বর্তমান জগতের মানুষের কোন কোন্ গুণ বেশি দরকারি তাহা আমরা উপলব্ধি করিতে পারি নাই। এই বিষয়টি পরে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হইবে।